বিবিধ

লড়াকু এক ফাইটার মহম্মদ হাবিব



দেবাশিস সেনগুপ্ত


১৯৭০-এর মে মাস। ছবির লোকটার বয়েস তখন ২৪ ছুঁইছুঁই। ঘোর কংগ্রেস শাসন তখন রাজ্যে। মোহনবাগানে সুব্রত মুখার্জী আর ইস্টবেঙ্গলে সোমেন মিত্রর ক্লাবে আনাগোনা হালকাপুলকা শুরু হয়েছে তখন। আর দু'দিকেই যাতায়াতের টেস্ট কেস চলছে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর। তবে কোনো পদে ছিলেন না তখন এরা কেউ। এই দুই ক্লাবের "প্রভাবশালী কর্তা" বা "পদাধিকারী"দের মধ্যে খুল্লমখুল্লা রাজনীতির লোক তখন দূরবীন দিয়েও দেখা যাচ্ছেনা।

এইরকম একটা সময়ে আমি তখন পনেরো। ইলেভেন, সায়েন্সে পড়ি। তখন মাধ্যমিক ছিলনা। সাত বছর ধরে একই স্কুলে পড়ে আসার সুবাদে স্কুলের সিনিয়রমোস্ট ব্যাচ। অখ্যাত বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ার দরুণ বাড়ির "কড়া অভিভাবকত্ব" ছাড়া খুব একটা "চেয়ে দেখতেন" না কেউ। স্কুলে একটা আদর্শ বাড়ির যাবতীয় মজা ছিল আর বাড়িতে আদর্শ স্কুলের মতো শাসনাধীন ছিলাম তখন। মোদ্দা কথা, স্কুলের শেষ দিকের ক্লাস বাঙ্ক করা যেত সহজেই। আর শেষ দিকের ক্লাস বাঙ্ক করা মানেই মে-সেপ্টেম্বরের গড়ের মাঠ, লিগের আর শীল্ডের খেলা।

তখন দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ক্লাস। লাল হলুদ আর সবুজ মেরুন। এত বিশেষজ্ঞ ছিলনা, ছিলনা জার্সির আস্ফালন, মাঠে পতাকা ছিলনা তখনো, ছিলনা টিফো, ব্যানার (এর কোনটাই আমার ব্যক্তিগতভাবে খারাপ লাগে না)। ছিল শুধু ক্লাব দুটোর প্রতি আকুতি। সবুজ মেরুন গ্রুপের কেউ কেউ সব খেলা দেখতে যেত, আমি টাফ ম্যাচ বেছে যেতাম। যেমন ভ্রাতৃ সঙ্ঘ, খিদিরপুর, এরিয়ান, ইস্টার্ণ রেল, বিএনআর। লাল হলুদ গ্রুপেও তাই ছিল। কেউ কেউ সব খেলা দেখতে যেত। কেউ কেউ বেছে বেছে।

লাল হলুদ গ্রুপের সব খেলা দেখতে যাওয়া একজন ছিল অরিন্দম। ওকেই জিজ্ঞাসা করতাম ম্যাচের কথা, রেডিওর রিলে মিস করলে। ও বলত ২৪ বছরের একজন বেঁটে ফুটবলারের কথা, তাঁর লড়াইর কথা। বলত, ওই একটা লোকই ফ্যাক্টর হয়ে যায় মাঠে। গোল না হলে একটা গোল করার জন্য আর এগিয়ে গেলে আরো বেশি গোল দেওয়ার জন্য তাতায় টিমকে। এবং গোল খেয়ে পিছিয়ে গেলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপক্ষের বিরুদ্ধে, সবাইকে সামিল করে। অরিন্দমের মুখে তাঁর লড়াইয়ের উপাখ্যান মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা, সবুজ মেরুন গ্রুপের অনেকেই।


বোম্বেতে টাটা ইনভাইটেশন একাদশের অধিনায়ক মহ. হাবিবের সাথে সাও পাওলো ক্লাবের অধিনায়ক বোনিফাসিও (ডানদিকে) পতাকা বিনিময় করছেন।


১৯৭৭ সালে প্রথম ভারত ভ্রমণে এসে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচ খেলছেন পেলে।

সেবার ইস্টবেঙ্গল টিমটাও কিন্তু দুরন্ত ছিল। লিগে খিদিরপুর (১-২ অবস্থায় পরিত্যক্ত) আর ডুরান্ডে রাজস্থান আর্মড কনস্ট্যাবুলারির কাছে হার ছাড়া সেবার অপরাজিত ছিল টিম ইস্টবেঙ্গল। কোচ পি. কে. ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে সুধীর কর্মকার, অশোকলাল ব্যানার্জি, নতুন আসা শ্যামল ঘোষ, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী, সুভাষ ভৌমিক, মহম্মদ আকবর ও অধিনায়ক স্বপন সেনগুপ্ত সমৃদ্ধ টিমের বাকি সবাইকে ছাপিয়ে অরিন্দমের চোখ দিয়ে কিন্তু আমরা দেখতে পেতাম শুধু একজনেরই লড়াই - মহম্মদ হাবিব।

সেবার লিগ, শীল্ড যেখানে পেয়েছিল, লোকটার ভার্চুয়াল লিডারশিপে আর লড়াইয়ে ইস্টবেঙ্গল পর্যুদস্ত করেছিল সুরজিৎ সেনগুপ্ত-সুব্রত চ্যাটার্জী-সৈয়দ নইমুদ্দিন-তরুণ বসু-বিনয় পাঁজা-বরুণ মিশ্র সমৃদ্ধ মোহনবাগানকে। ১৯৭৪-এর মার্চে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে স্কুল ছাড়ি। সেই বেঁটে ফুটবলার লোকটা কিন্তু আর ছেড়ে গেলনা আমাকে।

সেই থেকেই বিস্ময়, শ্রদ্ধা, প্রেম, ইজ্জত, ভালোলাগা তৈরির শুরু লোকটাকে ঘিরে। তারপরে আরো এক বছর ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে ১৯৭৫-এ মহমেডানে যাওয়া লোকটা ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮, এই তিন বছর সবুজ মেরুন জার্সিও পড়লেন। ১৯৭৯-তে আবার মহমেডানে গেলেন, তারপর তিন বছরে তিনবার দল পাল্টালেন। ১৯৮০-তে ইস্টবেঙ্গলে, ১৯৮১-তে মোহনবাগানে, ১৯৮২-তে আবার ইস্টবেঙ্গলে। আর তারপরে ফুটবলটাই ছেড়ে দিলেন, ১৯৬৬ থেকে টানা ১৭ বছর খেলার পরে। চিরকালীন ১০ নম্বর জার্সিধারী লোকটার প্রতি আমার সেই বিস্ময়, শ্রদ্ধা, প্রেম আর ভালোলাগা কিন্তু আর কখনো কোনওদিন দল পাল্টায়নি।

১৯৭৬-১৯৭৮, নিজের চোখে বহুবার অকুতোভয় মহম্মদ হাবিবকে দেখেছি বল কাড়ার জন্য প্রতিপক্ষের বুটের সামনে মাথা পেতে দিতে। ভয় না পেয়ে আসলে প্রতিপক্ষকে ভয় পাওয়াতেন তিনি। আমার মতো গড় ফুটবলপ্রেমীর কাছে "লড়াইয়ের প্রতিশব্দ" ছিলেন মহম্মদ হাবিব। যেখানে লড়াইয়ের আলো পড়ার সম্ভাবনা শূন্য, সেখানেও জমি তৈরি করে লড়াইয়ের এলইডি আলো জ্বালিয়ে দিতেন তিনি। এখনো জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো লড়াই দেখলে আমি 'মহম্মদ হাবিব' নামটাই পড়ি।

২০২৩-এর ১৫ আগস্ট মহম্মদ হাবিব দুনিয়াটাই ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর মাঠের লড়াই সহ ৫০ বছরের স্থায়ী লড়াকু এক ফাইটার রয়ে গেছেন আমার এবং কলকাতার ফুটবল মননে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।