নাম তার পলাশ, বয়স বারো। দেখতে দেবশিশুর মতো। ভাগ্য বিড়ম্বনায় আজ তাকে গ্রাস করেছে শোক, হতাশা আর একাকীত্ব। নয় বছর বয়সে পলাশের মা মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। মা মারা যাওয়ার পরে পলাশের বাবা পুনরায় বিয়ে করেন। তারপর অধিকাংশ পরিবারে যা হয়।পলাশের বাবার সদিচ্ছা থাকলেও পরিবারের শান্তির জন্য পিতৃকর্তব্য থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। নতুন ঘরে দু'বছর পরে পলাশের সৎভাই জন্মগ্রহণ করলে, সে হয় সংসারের ব্রাত্য।
পলাশ ক্লাস সিক্সে পড়ে। পড়াশোনায় তার মন বসে না, কথা বলে কম। সময় পেলেই নদীর ধারে, মাঠে-ঘাটে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফুল দেখলে তার দিকে সে মাছরাঙ্গার মতো তাকিয়ে থাকে। একা একা হাসে, ফুলের সঙ্গে কথা বলে। আবার আসার সময় হাত নাড়িয়ে টাটা-বাই বাই করে। তারপরে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির পথে রওনা হয়।
পলাশের মা ফুল ভীষণ ভালোবাসতেন। যখন তার মা বেঁচে ছিলেন, ঘরের চারপাশে বিভিন্ন রকমের ফুলগাছ লাগিয়ে বাড়িটাকে ফুলবাগান-বাড়ি করে তুলেছিলেন। বাড়ি ঢুকতেই বাঁশের তৈরি অর্ধচন্দ্রাকার গেটের উপরে মাধবীলতা মাথা দোলাতো সকালে বিকেলে। রাতে মৃদুমন্দ সুবাসে ভরিয়ে তুলত সারা বাড়ি। ঘরের জানালায় তরুলতা, অপরাজিতা সোহাগে মাথা তুলে উঁকি-ঝুঁকি মারত। বাড়ির দক্ষিণ দিকে কামিনী, কুন্দ ফুলের গাছ। সামনে-পিছনে কনকচাঁপা জুঁই বেল গোলাপ পাতাবাহার এবং রংবেরঙের গাঁদা। আরও কত ফুল! একদিন পলাশের মা পলাশকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "পলাশ বাবা তুমি বাড়ির চারপাশে ঘুরে এসো, তারপর তোমার দেখা ফুলগাছগুলোর নাম লিখে দেখাও আমাকে।" পলাশ খাতা কলম হাতে সারা বাড়ি ঘুরে এসে অনেক ফুলের নাম লিখে মাকে দেখায়। পলাশের লেখা সব ফুলের নাম পড়ে মা বলেছিলেন, "সবই ঠিক আছে তবে আসল ফুলটার নামই বাদ গেছে।" পলাশ মাথা চুলকোয় কিন্তু ভেবে পায়না। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খেয়ে একগাল মধুর হাসি হেসে বলেছিলেন, "আমার এই পলাশ ফুলটির নামই বাদ গেছে।" পলাশ মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে বলেছিল, "মা আরও একটা ফুলের নাম বাদ গেছে, বলতো কী?" সেদিন পলাশের মা-ও ভেবে পাননি আর একটা ফুল কী। অবশেষে পলাশ তার মায়ের মুখে তর্জনী নির্দেশ করে বলেছিল, "এই পদ্ম ফুল।" আসলে পলাশের মায়ের নাম ছিল পদ্ম। পলাশের মা পলাশকে সেদিন কাঁদো কাঁদো সুরে বলেছিলেন, "বাবা আমি যদি কোনওদিন মরে যাই তাহলে আমাকে দেখতে পাবে ফুলের মধ্যে।"
তাই বুঝি পলাশ পথে-ঘাটে ফুল দেখলে আনমনে চেয়ে থাকে, ফুলের মধ্যে তার মায়ের মুখটি খোঁজে বুঝি। চন্ডীপুর এবং প্রতিবেশী গ্রামের সবাই তাকে ফুল-পাগল বলে চেনে। তার মা মারা যাওয়ার পরে অযত্নে অনাদরে পলাশের মতো মায়ের হাতে সাজানো বাগানও শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুধু বেঁচে আছে শোক নিয়ে পলাশ শিশু গাছটি।
ফুলের মধ্যে মাকে খুঁজতে গিয়ে কত ঘটনাই-না ঘটিয়েছে পলাশ। একদিন সে কুন্ডুবাড়ির সামনে ফুল বাগানের রকমারি ফুল দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে সূর্যমুখী ফুলে বসে থাকা একটা ভ্রমরের ওপরে। পলাশের খুব রাগ হয়। সে ভাবে ফুলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে! সে দূর থেকে একটা কাগজ গোল করে পাকিয়ে ছুঁড়তে থাকে কিন্তু ভ্রমরটা কিছুতেই উড়ছে না। ভ্রমর ফুলের মধু খেতে মশগুল। তখন পলাশ বাধ্য হয়ে একটা মাটির ঢিল ছোঁড়ে; ছুঁড়তেই বৃন্ত ভেঙে সূর্যমুখী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! এই দৃশ্য লক্ষ্য করে কুন্ডুবাবুর ছোট ছেলে ছুটে এসে কঞ্চি দিয়ে পলাশের মাথায় আঘাত করে! মাথা ফেটে রক্ত বের হয়! কুন্ডুবাবু পলাশকে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
প্রথম দর্শনে পলাশকে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়, তবে একটা বিশেষ গুণ তার। সে কোনওদিন কোন গাছ থেকে ফুল তোলে না। গাছে ফুল দেখে সে ভীষণ আনন্দ পায়। অন্যান্য সমবয়সী বালকদের মতো চঞ্চল প্রকৃতির নয়। খেলাধুলায় একদম মন নেই। সহপাঠীরা তাকে ফুল-পাগল বলে খেপায়। তবে তাতে তার তেমন কোনো আপত্তি নেই।
ফুল অন্তপ্রাণ পলাশ স্কুলে যেতে যেতে কোনো ভালো ফুল দেখলে দাঁড়িয়ে দেখতো। কোনো কোনো দিন স্কুলে যেতে দেরি হতো, আবার কোনো কোনো দিন হয়তো স্কুলেই যেত না। পলাশের সৎ-মা বাজার থেকে কিছু আনতে বললে অথবা কোনো কাজে পাঠালে মাঝে মাঝে সে ভুলে যায়। দেখা গেল কারোর বাড়িতে ফুল বাগানে জল দিচ্ছে, ঘন্টা দুই পরে বাড়ি এসে হাজির! মায়ের হাতে ভীষণ মার খায়।অনেকে ভাবতো পলাশ অলস, আবার অনেকে মনে করত তার ভন্ডামি। কিন্তু অবচেতন শিশুমনে ঘুমন্ত মাতৃসত্তাকে ফুলের মধ্যে আবদ্ধ করে বেঁচে থাকার রসদ সে নিজেই জোগাড় করতো। তার এই মহানুভব শক্তিকে সমাজ গুরুত্ব দেয় না। উপরন্ত লোকে বলে ফুল-পাগল।
যেদিন স্কুলে মিড-ডে-মিল হতো না তার আগেরদিন প্রেয়ার লাইনে হেডমাস্টার জানিয়ে দিতেন, সেদিন পলাশ তার বাবার কাছ থেকে পয়সা নিত টিফিনের জন্য কিন্তু সেই পয়সা খরচ না করে জমিয়ে রাখতো। সেই জমানো পয়সা দিয়ে নার্সারি থেকে ফুলের চারা কিনে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি অপরের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আসত। নিজেদের বাড়িতে অনেকবার সে ফুলের চারা পুঁতেছে কিন্তু সৎ মায়ের চোখ রাঙানিতে সব বন্ধ হয়েছে।
একবার পলাশকে নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পলাশের বাবা তাকে তার মামা-বাড়িতে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরের দিনই পলাশের বাবা মা-মরা ছেলেকে নিয়ে রওনা হলেন। যাবার সময় পলাশ তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছে। স্কুলব্যাগে বইপত্র আর জামা প্যান্ট নিয়ে উদ্বাস্তুর মতো বাবার হাত ধরে পলাশ বেড়িয়ে পড়ে। পিছন ফিরে আর একবার দেখে নেয় মায়ের স্মৃতিঘেরা বাড়িটা। বাড়িতে ঢোকার আধভাঙ্গা বাঁশের গেটের দিকে চেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে পলাশ।
অবশেষে একরাশ হতাশা আর অবসাদ নিয়ে পলাশ পৌঁছে গেল মামাবাড়ির দেশে। মামাদের গ্রামে প্রবেশের আগে মেন রাস্তার ডান দিকে বিরাট তিনতলা প্রাচীর ঘেরা মাড়োয়ারি বাড়ি। সামনে বড় ফুলবাগান। রাস্তার দিকের পাঁচিল পুরোটা খোপকাটা জানালা, বাইরে থেকে চোখ পাতলে প্রায় সবকিছুই দেখা যায়। পলকের মধ্যেই সে দেখে নেয় রংবেরঙের ফুল। একটু দূরে মামা-বাড়ি। ক্ষনিকের মধ্যে তারা পৌঁছে গেল। পরের দিন পলাশের বাবা আসার সময় একশো টাকা দিয়ে দুই মুখে দুটো চুমু খেয়ে চোখের জলে বিদায় নিলেন। পলাশ তার বাবার পিছনে পিছনে মেন রাস্তার বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসে। বাবা যতক্ষণ না বাসে ওঠেন ততসময় সে দাঁড়িয়ে থাকে।বাস এল, তার বাবা উঠে গেলেন। চোখের সামনে বাস ক্ষণিকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। পলাশ গ্রহচ্যুত বিরল প্রাণীর মতো মামার বাড়ি ফিরে এল।
পরের দিন বিকেলবেলা পলাশ আসে সেই পাঁচিলঘেরা বাগানের সামনে। খোপকাটা ইটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ফুল-বাগিচার দিকে। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে চেনা অচেনা নানান ফুল। হঠাৎ তার হৃদয়টা নেচে ওঠে, বাগানের মাঝখানে জলের ফোয়ারা, তার পাশেই একটা পদ্ম গাছ। তাতে ফুল ফুটেছে! সেদিন থেকে সময় পেলেই পলাশ ছুটে আসে ফুল দেখতে। এমনি করে কয়েক দিন কেটে যায়। এর মধ্যে সে যে মালির চোখে পড়ে গেছে সেদিকে কিন্তু পলাশের খেয়াল নেই।
পলাশ মাড়োয়ারি বাড়ি ছাড়াও তদ্সংলগ্ন অন্যান্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। একদিন তার চোখে পড়েছে পাশের গ্রামের নার্সারি। নার্সারিতে মাধবীলতার চারা দেখেই তার মাথায় এলো, মাড়োয়ারবাবুদের বাড়িতে এই গাছ নেই তো! কি সুন্দর ফুলবাগান, চমৎকার গেট! মনে মনে ঠিক করে সে একটা মাধবীলতার চারা বসিয়ে দেবে মাড়োয়ারবাবুদের গেটে। বাবার দেওয়া টাকা থেকে একটা মাধবীলতার চারা কেনে পলাশ।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় চাদরের তলায় চারা গাছ আর টাঙি নিয়ে আসে কিন্তু বাগিচায় ইলেকট্রিকের আলো ঝলমল করে। হতাশ হয়ে ফিরে আসে। এমনি করে তিন চার দিন ওৎ পেতে বসে থাকে। যদি কারেন্ট চলে যায়। সেই সুযোগেই সে কাজ হাসিল করবে।
এমনি করে সপ্তাহখানেক পরে একদিন সত্যিই কারেন্ট চলে গেল সন্ধ্যারাতে।তড়িঘড়ি করে চারাটি গেটের ডানদিকে পাঁচিলের গায়ে পুঁতে দিয়ে উঠতেই কারেন্ট চলে এলো! হাতেনাতে পলাশ ধরা পড়ে যায় বিহারী দারোয়ানের কাছে। ইয়া বড় লাঠি দিয়ে সপাটে মারে! সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কে শোনে কার কথা, চোর চোর করে বাড়ি মাথায় তুলে নিল বিহারী। পলাশ জ্ঞান হারায়। মাড়োয়ারীবাবুর নির্দেশে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তার জ্ঞান ফেরে। পলাশের কাছে চুরির কারণ জানতে চাইলে সে কোনো উত্তর দেয় না। শুধু একটা কথাই সে বলে, আমি চোর নই বাবু। মাড়োয়ারবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে পলাশকে বলেন, তবে তোমার হাতে টাঙি কেন বাবা?
সে কিছু জানানোর আগেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মালি বলে, ব্যাটা পাকা চোর!ফুলের চারা চুরি করতে এসেছিল নিশ্চয়ই! ক'দিন ধরে দেখেছি পাঁচিলের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারতে। মাড়োয়ারীবাবু তার পরিচয় জানতে পারলেন, সে তারই হিসাব রক্ষক রঘুনাথের ভাগ্নে। রঘুকে ডেকে তার হাতে পলাশকে তুলে দিয়ে বললেন, রঘু তোমার ভাগ্নেকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও, তাতে তোমার সম্মান বাঁচবে। পরের দিনই মাড়োয়ারীবাবুর কথা অনুসারে পলাশকে তার মামা চন্ডীপুরের বাড়িতে রেখে আসেন।
মাড়োয়ারীবাবু ছিলেন নিঃসন্তান এবং ভীষণ ফুল-পাখি প্রেমী। অবসর সময় কাটান ফুল বাগানে। ঘটনার দিনদশেক পরে মাড়োয়ারবাবু ফুল বাগানে পায়চারি করছেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে পাঁচিলের গায়ে একটা কচি চারা মাথা দোলাচ্ছে। তিনি মালিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন - এই চারাটা কী ফুলের? কবে লাগানো হলো?
মালি মুখ নিচু করে চুলে আঙুল বুলিয়ে ইতঃস্তত বোধ করে বলল, "একটা কথা বলব বাবু?" মাড়োয়ারবাবুর সম্মতিতে দারোয়ান বলল, "আমার মনে হয় এই মাধবীলতার চারা ওই সেই ছেলেটি বসিয়েছে যাকে চোর ভেবে ধরেছিলাম। আমি অথবা মালি কেউই চারাটি গাছটি বসাইনি। ক'দিন ধরে আমি শুধু জল দিয়েছি। দারুণ ফুল বাবু! ভীষণ মিষ্টি গন্ধ!"
মালিকে মাড়োয়ারীবাবু বললেন রঘুনাথকে তলব করতে। পরের দিন গদিঘরে রঘুনাথবাবু হাজির হলেন। অতি অনুগত ভৃত্যের মতো জড়োসড়ো হয়ে বললেন, "আজ্ঞে আপনি আমাকে ডেকেছেন বাবু?"
- তোমার ভাগ্নে...
কথাটা শেষ না করতেই রঘুনাথবাবু সলজ্জিত সংকোচের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন,
- বাবু আর কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে আমার ভাগ্নে?
- না। তোমার ভাগ্নে সম্পর্কে আমার কিছু জানার আছে।
রঘুনাথবাবু বেশ উৎসাহের সঙ্গে সবিস্তারে পলাশের সম্পর্কে জানালেন। সব কথা শুনে মাড়োয়ারীবাবুর বুকটা কেঁপে উঠলো পলাশের জন্য। তারপর দরদী কন্ঠে তিনি বললেন,
- তোমার ভাগ্নেকে আমায় দান করবে? আমি নিজের সন্তানের মতো তাকে মানুষ করব।
মাড়োয়ারীবাবুর মুখে অপ্রত্যাশিত কথাটি শুনে রঘুনাথবাবুর বুকটা কেঁপে উঠল, চোখটা ভিজে গেল। তিনি প্রায় মাড়োয়ারীবাবুর পায়ে পড় পড় হয়ে বললেন,
- আমার ভাগ্নেকে বাঁচান বাবু।
- তাহলে চলো কালই আমরা চন্ডীপুরে যাই।
এদিকে মামা বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরে পলাশের আর কিছু ভালো লাগে না, তার শিশু মনটা বিষাদে ভরে গেছে। বাড়িতে একদমই মন বসে না। সেদিন সকালে বারান্দায় বই পড়তে বসে। তার চোখে পড়ে সেই গেটের অর্ধচন্দ্রাকার মাধবীলতা শূন্য শুকনো বাঁশের চাকতির দিকে। ভীষণভাবে মনে পড়ে যায় তার মায়ের কথা।
মাধবীলতার নিচে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ছেড়ে বিকালে মা মোবাইলের গানের সাথে গাইত "মালতীলতা দোলে দোলে পিয়ালী তরুর সাথে।" ভাবতে ভাবতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে বইয়ের পাতায়। এমন সময় পলাশের ভাই হঠাৎ কলপাড়ে পড়ে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে! নাক দিয়ে সামান্য রক্ত বেরিয়েছে! পলাশের সৎ-মা দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে তুলে আনেন, রেগে আগুন হয়ে পলাশের সামনে গিয়ে মুখ ঝাঁঝিয়ে বললেন,
- তোকে না বলেছি গুড্ডুকে দেখবি! তা না করে তুই বই পড়ছিস? মাকে খেয়ে তোর আশ মেটেনি? এবার আমার ছেলেকে...!
একথা শেষ করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে গেটের চাকতির বাঁশ খুলে মারেন ঘা কতক! হাতে পিঠে কালশিটে দাগ বসেছে। পলাশ জিরাফশিশুর মতো নিঃশব্দে সে যন্ত্রণা হজম করল।
মায়ের হাতে মার খেয়ে বিষন্ন মনে স্নান সারে সে, তারপরে না খেয়ে ব্যাগ নিয়ে পলাশ স্কুলের পথে বেরিয়ে যায়। টিফিন বেলায় স্কুল থেকে পালিয়ে সোজা চলে যায় দত্তবাবুদের পদ্মপুকুরে। পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে সে কথা বলে। মাঝে মাঝে মা-মা বলে ডেকে ওঠে। বিকেল গড়িয়ে আসে, গোধুলির আলোয় তার শিশুমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় পদ্ম পাঁকে নেমে মা-কে জড়িয়ে ধরে তার মনের অব্যক্ত গোপন ব্যথার পরিশ্রান্তি ঘটায়। আকাশে আধফালি চাঁদ, নির্জন সন্ধ্যায় সে ভুলে গেছে মায়ের মুখে দত্তবাবুদের পদ্মপুকুরের সেই মেছো ভূতের গল্পের কথা। সেই গল্পের মেছো ভূত যেন মায়াবী রূপ ধারণ করেছে পদ্মরূপে। নিষ্ঠুর ভূত নিষ্পাপ শিশুকে গ্রাস করার জন্য মায়ের রূপ ধারণ করে ডাকছে বুঝি! মাতৃস্নেহের অভাবে পলাশের কোমল বুকটা জয়চন্ডী পাহাড়ের পাথর হয়ে গেছে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আজ মা-কে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে তারপর সারারাত মায়ের সঙ্গে কথা বলবে।
পলাশ আস্তে আস্তে নেমে যায় কচুরিপানা-শ্যাওলা তারপর নাল ফুলের পাতা সরিয়ে পদ্মফুলের দিকে। দিঘির পাঁক যেন মেছো ভূত গ্রাস করে তার গভীরতাকে বাড়িয়েছে। পলাশ নিমেষের মধ্যে ডুবে গেল আঁধার কালো জলে। পলাশ সারারাত মায়ের সাথে চাঁদ ছুঁই ছুঁই খেলা খেলে ক্লান্ত হয়ে নিথর হয়ে গেছে। সকালে সবাই দেখল ফুল-পাগল পলাশ দিঘির জলে চির নিদ্রায় শায়িত! হাতে একটা পদ্মফুল! আকাশের দিকে চেয়ে আছে তার ভাসমান দেহটি। প্রাণটা সুদূর মায়ের পথে। মৃত ফুল-পাগলকে দেখার জন্য দু' চার গ্রামের মানুষ ভিড় জমিয়েছে। চোখের জল ফেলল অনেকেই। পলাশের নিষ্প্রাণ দেহটা তুলে তারা শুইয়ে দিয়েছে উঠোনে। দুপুর গড়িয়ে গেলে মাড়োয়ারীবাবু ও তাঁর স্ত্রী এবং পলাশের মামা এসে হাজির। চিরজীবনের মতো ঘুমিয়ে পড়া পলাশকে দেখে তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।