গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (পঞ্চদশ পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


সেই পাচুকাকা আজ ওদের দোকানের একজন বিশ্বস্ত কর্মী। পরে জেনেছিলাম, জীবেশ তার মাতুলালয় থেকে ধার করে এনেছিল এবং সেই টাকার অনেকটাই চিনুর চিকিৎসার জন্য দান করে। জীবেশের মামা বাড়ি রায়গঞ্জ। রায়গঞ্জের এক বনেদী পরিবারের মেয়ে জীবেশের মা। দান-খয়রাতের তালিকায় ওর মামাবাড়ির যথেষ্ট সুনাম আছে। প্রতিটি পরব, উৎসব-অনুষ্ঠান এবং বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে ওর মামাবাড়িতে গরীব দুঃখী এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সমাগম ঘটে। পেটপুরে খেয়েদেয়ে তারা প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। রায় বাড়ির সেই রীতি আজও অক্ষুণ্ণ আছে। মামার ছেলেদের অনেকেই বিদেশে নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অঢেল সম্পত্তি - টাকাপয়সা, জমিজমা, বাগান পুকুর, মোট কথা অভাব জিনিসটা ওঁদের অভিধানে নেই। জীবেশ মাঝে মাঝেই বলে - মামাবাড়ি গেলে মনে হয়, আমি এদের ভাগ্নে হবার উপযুক্ত নই। তবুও মায়ের টানে আসতে হয়।

বাবা বলেন - মামাবাড়ি অবশ্যই যাবে কিন্তু তাঁদের যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বলবে তোমরা আমাকে যে সম্পদ দিয়েছো তার কাছে এগুলো মূল্যহীন। হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার মা।

মায়ের মৃত্যুশয্যায় জীবেশ কথা দিয়েছিল - যদি সত্যি সত্যি জীবনে কোনোদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারি তবে বিপন্ন অসহায় মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো।

জীবেশ পাচুকাকুকে কথা দেবার পর টাকা সংগ্রহের জন্য মামাবাড়িতে গিয়েছিল। না, ওর প্রাপ্য নিতে নয়। কিছু টাকা ধার হিসেবে নেওয়ার জন্য। কেননা ও এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এতগুলো টাকা বাবার কাছে চাওয়া যাবে না। কিন্তু মামাবাড়িতে এব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। তাছাড়া বড়ো মামা যথেষ্ট উদার এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন।

বড়ো মামা বলেছিলেন - এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তুই তো আমাদের এই সম্পত্তির একটা অংশ পাবি। প্রাচুর্যের এই অগাধ সমুদ্র থেকে এক গণ্ডূষ জল নিলে যদি কারোর প্রাণ বাঁচে তাহলে তোর প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে যা না। এতে আমাদের সম্পদ বাড়বে বই কমবে না। এত ভালো একটা কাজ তোর মা বেঁচে থাকলেও এমন কথাই বলতো।

জীবেশ টাকা এনেছিল এই শর্তে যে, আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যে সবটাই পরিশোধ করে দেবে। প্রথমে মামা-মামী দুজনেই আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু জীবেশের অনমনীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে ওঁরা যেতে পারেননি। মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং মাতৃপক্ষের দানশীলতার কারণেই সে তার অচেনা বোন চিনুর জন্য সবটাই দান করে দিয়েছিল। কতটা দরদী মন হলে একজন অজানা অচেনা চালচুলোহীন ব্যক্তির জন্য নিজের সম্পত্তির একটা বৃহৎ অংশ উজাড় করে দেওয়া যায়। আরও অনেক ঘটনা আছে যার সবটা এক এক করে বলতে শুরু করলে একটা গোটা মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। কলেজ জীবনের প্রথম দিকে আমাকেও একবার সাহায্য করতে চেয়েছিল। ও দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল করেছিল যে, আমি একটা ভাঙাচোরা লঝঝড়ে গোছের সাইকেল নিয়ে কলেজে আসি। এটা ভেবেই একদিন সে আমাকে বললো - জয়, তোর সাইকেলটা না আমার খুব পছন্দ। ওটা আমাকে দিস তো। আমি ওটা চালাবো আর তোকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেবো।

আমি ওর মতলব বুঝতে পেরে বললাম - না বাবু, সেটি হচ্ছে না। এটা আমাকে আমার এক প্রিয় বন্ধু দান করেছে। এবার তুই-ই বল দানের জিনিস কাউকে দেওয়া কী ঠিক? তার চেয়ে বরং তুই যে নতুন সাইকেলটা কিনতে চাইছিস সেটা নিয়ে আয় আমি মাঝে মাঝে চালাবো।

জীবেশ বুঝতে পেরেছিল যে, জয় কারও সাহায্য নিতে চায় না। তাই এব্যাপারে আর কোনোদিন কোনো কথা বলেনি। আমি ও নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। এমন কৌশলে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গেলাম যে, সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না। পরে একদিন কথায় কথায় বলেছিল - আমি জানি রে জয়, সব জানি এবং বুঝি। তবে এটা ঠিক যে, একদিন তুই মানুষের মতো মানুষ হবি। সেদিন কিন্তু তোর এই অধম বন্ধুটার কথা মনে রাখিস। আর যদি কোনোদিন কোনোভাবে তোর মনে হয় যে, আমি কোনো কাজে আসতে পারি তাহলে অবশ্যই আমাকে স্মরণ করিস বন্ধু। আমি যে তোকে খুব ভালোবাসি।

জীবনের কিছু কিছু কথা কিছু কিছু মুহূর্ত সহজে ভোলা যায় না, জীবেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মাঝে মাঝেই মনের ভেতর জমে থাকা এক অব্যক্ত যন্ত্রণা আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। কোন অপরাধের ফলে আজ আমার মা, দাদা, দিদি, ভাই এবং রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো থাকা সত্বেও আমি বড্ড একা। আমার একাকীত্বের সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী আমার বই, আর রবীন্দ্রনাথ। বই আমাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয় আর রবিঠাকুর আমার ব্যথা-যন্ত্রণা লাঘব করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার সুবাদে আমার দূর সম্পর্কের এক দিদি আমাকে একটা ছোটো একটা পকেট রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। যতক্ষণ বাড়ি থাকি ততক্ষণ রেডিওতে গান শুনি, নানারকম অনুষ্ঠান শুনি। তখন দূরদর্শনের এত রমরমা ছিলো না। গ্রাম শহরের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে রেডিও ছিলো একজন বন্ধুর মতো। মাঠে যাঁরা চাষাবাদ করতেন তাঁরাও রেডিও সঙ্গে নিয়ে কাজে নামতেন, একদিকে রেডিও বাজছে অপরদিকে তিনি কাজ করছেন। এক এক দিন মনটা চলে যেত ওদের কাছে, মাঝি-মাল্লারাও সন্ধেবেলা নৌকায় বসে ডিমের ঝোল রান্না করতে করতে রেডিও শুনতো। রেডিওর কথা উঠলেই আমার শৈশবের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী, শীতকালে নদীতে খুব বেশি জল থাকতো না। অনেকে হেঁটে হেঁটেই ইছামতী পেরিয়ে যেত। কিন্তু বর্ষাকালে নদী অন্য চেহারা নিত, তখন নদীকে চেনা যেত না। ইছামতীর বুকের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতো বড়ো বড়ো জাহাজী নৌকা। ওরা কখনও কখনও আমাদের গঞ্জের বাজার থেকে কম দামে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে বড়ো বড়ো শহরে বিক্রি করতো। আমরা জনাকতক বন্ধু সাঁতার কেটে নদী পারাপার করতাম। চোখ দুটি যতক্ষণ লাল না হতো ততক্ষণ আমরা উঠতাম না। কোনো কোনো দিন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে স্কুলে পৌঁছাতাম। মাঝে মাঝে মাস্টারমশাই-এর বকুনিও খেতে হতো। কিন্তু বেশ মজা লাগতো। নদীতে সাঁতার কাটার সময় জাহাজি নৌকার মাঝিদের সাথে আলাপ হতো। ওদেরকে হাতে হাতে একটু কাজ করে দিলে মাঝে মাঝেই উপরি পাওনা হিসেবে ডিমের ঝোলের আস্বাদও লাভ হতো। তখন মনের অন্দরমহলে আজকের মতো এতো জটিলতা তৈরী হয়নি, তাই কে কোন জাত সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু বাড়িতে একবার যদি মায়ের কানে পৌঁছাতো যে, আমি মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে ওদেরই পাত্রে খাবার খেয়েছি তাহলে মায়ের বচন তো জুটতোই তার সাথে জুটতো উত্তম মধ্যম প্রহার। আর শুরু হতো বকুনি বর্ষণ তার ফলে মনে হতো পেটের ভাত বুঝি পুনরায় স্বস্থানেই ফিরে যাবে।

এখন আমি আর ছোটোটি নেই, তাছাড়া সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হয়। যে বাড়িতে ভাড়া আছি ওরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আগের বাড়ি ছেড়ে আর একটা নতুন বাড়িতে। এখান থেকে আমার কলেজ পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। তাছাড়া টিউশনি গুলো সব কাছাকাছি, তাই এখানেই ঘর নিলাম। একটা ছোটো টালির ছাদ, তার উপরে ত্রিপল দেওয়া, বর্ষার সময় বা সামান্য বৃষ্টি হলেই জল পড়ে। জল আটকানোর জন্য ত্রিপল দেওয়া, বেশি বৃষ্টি হলে জল আটকাতে পারে না, ভাড়া খুবই কম, পাশাপাশি ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা আমার কাছেই পড়ে। ভাড়া দিতে হয় না, বরং বাড়িওয়ালা আমাকেই টাকা দেন। এ বাড়িতে আসার আগে পাড়ার কয়েকজন বলেছিলেন - ভাড়া নিয়েছো ভালো কথা, কিন্তু এখানে বেশিদিন টিকতে পারবে না।

- কেন?

- আসলে বাড়িওয়ালার স্ত্রী খুব একটা সুবিধার নন। যারাই আসে তারা দুতিন মাসের বেশি থাকতে পারে না।

- আমি কিন্তু অন্যদের মতো নই। আমি যেখানেই যাই না কেন, তাঁরা আমাকে ছাড়তে চান না, আমার জন্য চোখের জল ফেলেন। জানিনা কেন তাঁরা আমাকে এত ভালোবেসে ফেলেন।

প্রতিবেশী একজন বললেন - কিছুদিন থাকলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আমরা এ পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা তাই আমরা এ পাড়ার বাসিন্দাদের হাঁড়ির খবর বলে দিতে পারি। তোমাকেও বললাম, মানে সাবধান করলাম আর কী।

- আপনার সাবধানবাণীর জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমি আপনার কথাগুলো মাথায় রাখবো।

ভদ্রলোক চলে গেলে মনের ভেতর কিছু প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গেল - কেন? কী কারণে? উদ্দেশ্যই বা কী? পৃথিবীতে কত রকমের মানুষ আছেন তা আমাদের ধারণার অতীত। কে যে কার ভালো চান বা মন্দ চান, তাঁর বা তাঁদের উদ্দেশ্যই বা কী সেটা বোঝা আমাদের কম্ম নয়। সুতরাং -

প্রশ্নগুলোকে সরিয়ে দিয়ে ঠিক করলাম মনটাকে শক্ত করে সকলের সতর্কবাণী মাথায় রেখেই এগিয়ে চলবো। তারপর যা হয় হবে।

(ক্রমশ)