গল্প ও অণুগল্প

একটি পেরেক ও কয়েকটি আলু



দ্বিজরাজ সান্যাল


সেন্ট্রাল প্লেসের চৌকো মাঠের মাঝখানে বিশাল মঞ্চ বানিয়ে পাশাপাশি বাইশটা অস্থায়ী ফাঁসিকাঠ দাঁড় করানো হয়েছে। সবকটাতেই ঝুলছে চকচকে দড়ির ফাঁস। পাশেই বোমা-বিধ্বস্ত সিনাগগের গম্বুজে গত তিনবছর ধরে তিনটে বারো বেজে থাকলেও এখন সকাল ন'টা বাজে। বসন্ত এসে গেছে তবু ঠান্ডার রেশ এখনো যথেষ্ট। সামান্য কুয়াশাও আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে দড়ির ফাঁসগুলো যেন জার্মান শেফার্ড কুকুরদের জিভের মতো লকলক করছে। আজ ঠিক সকাল দশটায় এই মঞ্চে একসঙ্গে বাইশজন অপরাধীর ফাঁসি হবে। ঘেটোর ঘর রাস্তা ফাঁকা করে মাঠের চারপাশে বন্দী সব সুস্থ ইহুদী আর জিপসী নারী পুরুষ জড়ো হয়েছে। জড়ো হয়েছে বলার চেয়ে বলা ভালো জড়ো হতে বাধ্য করা হয়েছে। এই নির্মম মারণযজ্ঞ বাধ্যতামূলকভাবে দেখতেই হবে প্রত্যেককে। ঘেটোর অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার রস-কে এই ফাঁসির ছবি তোলার পারমিট দেওয়া হয়নি। তবু সে কোটের গুপ্ত পকেটে নিয়ে এসেছে তার প্রিয় লাইকা ক্যামেরা। এই হত্যালীলা প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ফ্রেমবন্দী করতেই হবে তাকে।

এই ঘটনা জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডের উজ্‌ ঘেটোর। মজার ব্যাপার হলো, যখন বাইশ জন ইহুদীকে বাইরে থেকে খাদ্য, জ্বালানী আর ওষুধ ঘেটোর ভেতর স্মাগলিং করার অপরাধে ফাঁসি দিয়ে অন্যদের কাছে ভয়ানক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে জার্মানরা, তখনও কিন্তু স্মাগলিং অব্যাহত ঘেটোর ভেতর। তবে এই পর্যায়ে কুশীলব হলো ছয় থেকে বারো বছরের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। আজ ঘেটো ফাঁকা, তাই বাচ্চাগুলো সব বেরিয়ে পড়েছে খাবার আর জ্বালানীর সন্ধানে। ঘেটোর এ-গলি সে-গলিতে খেলার ভান করে সেন্ট্রিদের নজর এড়িয়ে তারা এগিয়ে গেছে ঘেটোর দেয়ালের দিকে। সেখান থেকে পাখি বা ঘোড়ার ডাক নকল করে সিগনাল দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে তাদের পোলিশ আর জার্মান বন্ধুরা ছুঁড়ে দিচ্ছে আস্ত লোফ, চিজ, সুগার, কেরোসিনের বোতল, কয়লার টুকরো। কখনো সখনো হ্যাম, সসেজ, চকোলেট। মাটিতে পড়ে খাবারগুলোতে নোংরা লাগছে। কিন্তু সেসব নিয়ে বাছবিচারের ছুঁৎমার্গ কবেই চলে গেছে ওদের। পেটের দায় বড় দায়। চরম খাদ্যাভাবে তাই খুদেরা বই, পেন্সিল, রঙ-তুলি ছেড়ে সক্কলে স্মাগলার হয়ে গেছে।

দশটা বাজতে আর মিনিট বারো বাকি। বাইশজন অপরাধীকে মঞ্চের নিচে একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকের পেছনে একজন করে রাইফেলধারী জার্মান সৈন্য। ওদিকে মঞ্চের ওপরে ফাঁসুড়ের দল প্রত্যেকটা ফাঁসদড়িতে আরও একবার মোমপালিশ করছে খুব দ্রুততার সঙ্গে। ওরা সকলেই ইহুদী। স্বজনদের ফাঁসির প্রস্তুতি করতে তাদের হাত-পা কাঁপলেও বন্দুকের নলের সামনে তারা নিরুপায়। তাদের প্রতি ঘেটোবন্দীরা তাই সমব্যথী। উলটোদিকে জার্মানদের দালাল ঘেটোপ্রধান প্রবীণ-ইহুদী রুমকোভস্কি, যে এই মারণযজ্ঞের প্রস্তুতির দেখভাল করছে - তার প্রতি বন্দীদের ঘৃণা, ক্রোধ আর তামাশার অন্ত নেই। বাইশজনের মধ্যে সতেরজন পুরুষ, বাকিরা মহিলা। অকথ্য অত্যাচারের কারণে ওদের বেশিরভাগেরই মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, এমনকি নারী পুরুষের পার্থক্যটুকুও করা যাচ্ছে না। মৃতপ্রায় শরীর নিয়ে তারা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত থাকতে পারছে না। যতবার টলে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে, সশস্ত্র প্রহরীর হুংকারে আবার নিজেকে টেনে তুলে দাঁড় করাচ্ছে কোনোরকমে। এই করুণ দৃশ্য দেখে যখনই দুঃখে লজ্জায় মাথা নীচু করছে কোনো সহমর্মী ইহুদী দর্শক, গেস্টাপোর চাবুকের ডগা উঁচিয়ে ধরছে তার চিবুক। মনুষ্যেতর ইহুদীদের এই নির্মমতা দেখতে বাধ্য করাই তো জার্মানদের অহংকার, জাতিস্পর্ধা। ঘেটোবন্দীদের কাছে খবর এসেছে, কুখ্যাত গভর্নর হান্স ফ্রাঙ্ক স্বয়ং আসছে এই হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করতে। সশরীরে ক্রাকভ গিয়ে তাকে নেমন্তন্ন করে এসেছে জার্মানদের দালাল রুমকোভস্কি।

স্মাগলিং-এর সময় গেস্টাপো আর সেন্ট্রিদের অঙ্কের ম্যাজিক দেখিয়ে ব্যস্ত রেখে বাচ্চাদের পরোক্ষে সাহায্য করে ম্যাথামেটিক্সের ম্যাজিশিয়ান মারেক। জার্মানরা তাকে পাগলা ম্যাথামেটিশিয়ান বললেও সমীহ করে বেশ। এটা সম্ভবতঃ সাবজেক্টটারই মাহাত্ম্য। বাচ্চাগুলো যখন খাবার আর জ্বালানী তাদের কোট, প্যান্টের চোরা পকেটে ঢোকাচ্ছে তখন তারা দেখে ইজরায়েল ঠেলাগাড়ি ভর্তি আলু নিয়ে যাচ্ছে ক্যান্টিনের দিকে। আজ সে একা, ঘেটোর সেন্ট্রিরা সব বধ্যভুমিতে পাহারায় ব্যস্ত। পোলিশদের খুবই প্রিয় খাবার আলু। তাই আজকের এই সুবর্ণ সুযোগ ছেলেমেয়েগুলো হাতছাড়া করতে চায় না। প্রত্যেকে নিজেদের কোটের ভেতর থেকে বের করল লুকোনো লাঠি। চেরি গাছের শুকনো ডাল দিয়ে তৈরী লাঠিগুলোর মাথায় আড়াআড়িভাবে গোঁজা রয়েছে পেরেক। গাড়ির পেছনে হাঁটতে হাঁটতে তারা ওই পেরেকে গেঁথে ফেলছে একটা করে আলু আর সঙ্গে সঙ্গে চালান করে দিচ্ছে শরীরের গোপন কুঠুরিতে।

বছর পাঁচেকের ছোট্ট ছেলে ইয়াকবও দাদা দিদিদের সঙ্গে একাজে হাত লাগিয়েছে। সে আলুগুলো নিয়ে তার ব্লকে যাবে। তার প্রিয় দিদিমাকে দিয়ে বলবে স্ম্যাসড্‌ পটেটো রান্না করতে। সামনের দিকে মুখ করে গাড়ি টানার দরুন পেছনে বাচ্চাগুলোর কী কুকর্ম করছে টের পাচ্ছে না ইজরায়েল। তার ওপর মারেক ওকে গল্প করে ট্রেনের দৈর্ঘ্য আর গতিবেগের অঙ্ক শেখাচ্ছে। ছোট্ট নরম হাতে লাঠি ছুঁড়ে ইয়াকব সবে তিনটে কি চারটে আলু পেরেকে গেঁথে পকেটে চালান করেছে, হঠাৎ প্রবল হুংকারে "হাল্ট, হাল্ট" বলতে বলতে ছুটে আসে এক গেস্টাপো অফিসার। বাকী বাচ্চারা ছুটে পালিয়ে গেলেও ইয়াকবকে ধরে ফেলে দীর্ঘাঙ্গী সেই গেস্টাপো। যেভাবে একজন কসাই মুরগিকে ধরে জবাই করার আগে, ঠিক সেইভাবে বাচ্চাটার ঘুঁটি চেপে ধরে শূণ্যে তুলে প্রকান্ড অট্টহাস্য হাসছে কালো উর্দি পরা সেই জার্মান পুলিশ। ছেলেটার জামার ভেতর লুকোনো আলুগুলো মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল বেশ কিছু দূর। আতঙ্কে শিউরে উঠল মারেক। ইজরায়েল ঠেলাগাড়ি নিয়ে পালালো জার্মান অফিসার্স ক্যান্টিনের দিকে।

ওদিকে বধ্যভূমির যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ। দশটা বাজতে আর মাত্র দু'মিনিট বাকি। সামরিক পোশাকে সজ্জিত গভর্নর ফ্রাঙ্ক তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মিলিটারি পোষাক টান টান করল। তারপর চৌকো চোয়াল শক্ত করে পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল নিজের সুইস হাতঘড়ির দিকে। বাইশজন সেন্ট্রির পালিশ করা কালো জুতো স্টুলের পায়ায়। প্রত্যেক স্টুলের ওপর গলায় দড়ি পরিয়ে দাঁড় করানো আছে নিরপরাধ অপরাধীদের। ঠিক দশটা বাজলেই হান্স হাত থেকে রুমাল মাটিতে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গেই জুতো দিয়ে স্টুলগুলো ঠেলে সরিয়ে দেবে সেন্ট্রিরা। মাঠভর্তি মানুষ প্রত্যক্ষ করবে স্বজাতির গণফাঁসির দৃশ্য। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আকাশ জুড়ে কালো মেঘ।

অন্যদিকে ঘেটোর ভেতর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে বেচারী মারেক দু'হাত দূরে দাঁড়িয়ে সেই গেস্টাপোর নির্দেশে তাকে গল্পের মতো করে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে - ওই বাচ্চাটিকে শূণ্যে ছুঁড়ে দিয়ে গুলি করলে সেই গুলি ঠিক কোথায় লাগবে তার। শূণ্যে ছটফট করছে ইয়াকব। গেস্টাপোর পাশবিক হাসি যেন থামতেই চাইছে না। অঙ্কের গল্প বলতে বলতে জার্মান দানবটার প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ম্যাথামেটিক্স ম্যাজিশিয়ান। তারপরেই অঙ্কেরই যাদুতে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গেস্টাপোর হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করে পরপর দুটো গুলি করল। তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল সেই জার্মান বীরপুঙ্গব। মুঠো তার আলগা হয়ে যায়। তখুনি গাছের ডাল থেকে পাখির ছানার মতো মাটিতে খসে পড়ে বাচ্চা ইয়াকব। কয়েক সেকেন্ড থম মেরে পড়ে থাকে সে রাস্তায়। তারপরই উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

"ইউ সোয়াইন..."!

এই বলে সেই দীর্ঘাঙ্গ পুলিশ হাত বাড়িয়ে ধরতে যায় মারেককে, কিন্তু পারে না। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তার ওপর। তার বুক ফুঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরচ্ছে রক্ত, বিস্ফারিত দু'চোখ। প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ঘোর কাটতেই তাড়াতাড়ি হাতের পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মারেক। তাকালো নিজের হাতের দিকে। এই হাত দিয়েই কি সে যুদ্ধের আগে চক-ডাস্টার ধরে অনেক জটিল অঙ্কের সমাধান করেছে!

মারেক যখন গেস্টাপোর বুকে প্রথম গুলিটা করে, ঠিক তখুনি বধ্যভূমির মাটিতে লাল রুমাল ফেলেছিল গভর্নর ফাঙ্ক। গেস্টাপোর বুকে দ্বিতীয় গুলি লাগার মুহূর্তে ফাঁসিকাঠে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলো চিৎকার করে বলে উঠেছিল, "পোল্যান্ড স্বাধীন হোক"। শর্ট লেংথ্‌ দড়িতে ফাঁসি দিলে মৃত্যু হতে দেরি হয়। তাই ওদের সকলের দেহ এখনো নিথর হয়নি। কারো কারো শরীর কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। নাৎসি আদেশ মোতাবেক বাইশজনের মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজেও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সব বন্দী দর্শকদের।

অতএব আর কয়েক মিনিটই মাত্র সময় পাওয়া যাবে। ইয়াকব শুদ্ধু বাকী বাচ্চাগুলো এরমধ্যেই গেস্টাপোর মৃতদেহ তুলে নিয়ে গিয়ে নর্দমার ভেতর লুকিয়ে ফেলেছে। অকুস্থলের বেশিরভাগ রক্ত বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেলেও পুরোপুরি যায়নি। পথের ওপর মাথায় হাত দিয়ে থেবড়ে বসে পড়ল মারেক। অবিরাম বারিধারা মাথায় করে সে ভাবতে বসল, বাকি রক্তের দাগটুকুও অঙ্কের ম্যাজিক দেখিয়ে তাকে খুব দ্রুত ধুয়ে ফেলতেই হবে। কারণ সেও চায় 'পোল্যান্ড স্বাধীন হোক'।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।