'আনন্দ' (১৯৭১) ছায়াছবির একটি দৃশ্য।
নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা শব্দ দুটোর প্রতি আমার ভয়ংকর লোভ। অথচ, সময় আমার মুঠোয় সেই নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা ভরে দিয়ে মুখ ফেরালেই আমি নিজেই সেগুলোর শত্রু হয়ে উঠি। মুঠো খুলে নির্দ্বিধায় ঝেড়ে ফেলি সমস্ত নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা। অনিশ্চিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার হুজুগে আরও কতবার নিরাপত্তাহীনতার চক্রব্যূহে ঢুকে জীবন উৎসর্গ করব জানি না।
জীবন? নাহ, একটু ভুল বললাম। বেঁচে থাকা বাজি রাখার এই প্রক্রিয়াকে জীবন উৎসর্গ করা বলা যায় না। নিরাপত্তাহীনতায় ভেসে থাকা অনিশ্চিত বেঁচে থাকাই কি আদতে জীবন নয়? হয়তো তাই। হয়তো নয়, আমি বিশ্বাস করি সেটাই জীবন। বাঁধাধরা গড়পড়তা ছকে ফেলা বয়সের মধ্যে নিজেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তো একপ্রকার কাপুরুষতা।
ঋষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত 'আনন্দ' (১৯৭১) ছায়াছবির একটি দৃশ্যে রাজেশ খান্না।
কিন্তু, এসব জানা, বোঝার পরও প্রতিমুহূর্তে একটা দ্বন্দ্ব আমার বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়ে যায়। জীবন যেখানে একার নয়, যখন জীবন আরও অনেককে জড়িয়ে নিয়ে এতদূর এগিয়ে এসেছে তখন কি এই অনিশ্চিত স্বপ্নের প্রতি প্রেমের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক? নিজেকে অনবরত, প্রতি মুহূর্তে প্রশ্ন করি। এত এত ঈর্ষান্বিত দৃষ্টির মধ্যে থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, ঝুঁকির পুরস্কার তুলে নিয়ে দু-একদিনের অবসরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় জীবন মাঝেমধ্যে গর্ব করে। করা উচিতও। কিন্তু অবসরের আলো ফুরিয়ে এলেই স্বপ্নের অন্ধকার হাতড়ানো নিজেকে খুব ব্যর্থ, অপদার্থ মনে হয়। মনে হয় যাবতীয় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে অন্য অনেককেই আহত করছি প্রতিমুহূর্তে। এই অপরাধবোধ থেকে এক প্রগাঢ় ভীতির সঞ্চার হয়। যে ভয় আমাকে এক বৃত্তের মধ্যে মধ্যে বন্দী করে রাখে। সময় এগিয়ে যায় আর আমি মৃত্যুর দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে অনিশ্চয়তার অবৈধ প্রেমে বাধা পড়ে যাই। জীবন আর বেঁচে থাকার দ্বন্দ্বে জীবন বাঁচার আনন্দটাই মাটি করে দিয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় নিজেকে চিনতে পারি না। অল্পে চিৎকার করি, বিরক্ত হই আর ক্রমশ নিজের স্বপ্নের থেকে, নিজের আপনজন থেকে দূরে সরে যাই। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিটাকে মেনে নেবার সাহস হারিয়ে ফেলে ভুল করি। একবার, দু'বার নয়, বারবার। বারবার একই ভুল করলে তাকে অপরাধ বলে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি। কাজেই অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন স্বপ্নের প্রলোভনে আমি অপরাধী হয়ে পড়ি। শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। জীবন তৈরি থাকে বিচারকের ভূমিকায়। ভুল যে তারও হয় না এমন নয়। জীবন ভুল করে আর বেঁচে থাকাগুলোকে অসহনীয় করে তোলে। প্রতিটি লোভ ভোল পালটিয়ে, মেকাপ বদলিয়ে জীবন আর বাঁচার ছকে এক্কাদোক্কা খেলে। পাশে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি আর একটু একটু করে সেই খেলায় অংশগ্রহণ করতে উদ্দীপিত হই।
প্রতিটি খেলায় হারজিত থাকে আর জেতার ইচ্ছে নিয়ে খেলতে নামলেও জেতে শুধু সময়। কারণ তারই আছে অনেক অনেক অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। সময়ের কাছে হার মেনে মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম স্ট্রেস। রক্তচাপ আর রক্তের শর্করা বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে অস্থিরতা।
পথ বদলিয়ে ক্ষুব্ধ জীবন বাঁচতে চায় আর দমবন্ধ করা বেঁচে থাকা জীবনের লোভে পড়ে পথ বদলায়, মত বদলায় অনবরত। এইমুহূর্তে বুলিশ তো পরমুহূর্তেই বেওয়ারিশ।
আসলে আমিও অনেকের মতন একটা শর্টকাটের ট্রাপে পড়ে গেছি। বিনিয়োগের বদলে ট্রেডিংয়ের লোভে সম্পদ হারাচ্ছি জীবনের। শান্তির বদলে অশান্তির পোর্টফলিও নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষায় আয়ু ফুরিয়ে ফেলার আতঙ্ক সঞ্চয় করে বসে থাকি। অনিশ্চিত স্বপ্নের ভিতরে নিরাপত্তার বুদবুদ একদিন ফেটে গেলে জীবন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ চিনতে শেখে আর পরিণতির দায় সামলাতে সামলাতে বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে শেখে জীবন।