প্রবন্ধ

টমাস বাটা ও কোন্নগর



অমলেন্দু হাইত


খবরের কাগজের পাতা জুড়ে যখন বিজ্ঞাপন বার হতো "পুজোয় চাই নতুন জুতো - বাটা"। মনের মধ্যে একটা আনন্দ... পুজোর গন্ধ নাকে এসে লাগত। খুঁটিয়ে দেখতাম কম দামের মধ্যে কিছু কেনা যায় কি না। এই জনপ্রিয় ব্র্যান্ডটি সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ এক চর্ম পরিবারের (Cobbler) সপ্তম পুরুষ স্যার টমাস বাটা (Tomas Bata)। বাবার একটা ছোট্ট কারখানাকে রূপ দিলেন এক বিশাল সাম্রাজ্যে। ১৮৭৬ সালের ৩রা এপ্রিল জন্মেছিলেন Austro Hungarian-এ, বর্তমানে যা চেকোস্লোভাকিয়া নামে পরিচিত।

১৯২৫ সালে তিনি এলেন কলকাতায়। ছোট্ট গোডাউন ভাড়া করে জুতো বিক্রি শুরুর সাথে এদেশের অধিকাংশ মানুষের খালি পা দেখে ভাবতে শুরু করলেন কি করে সস্তায় এদেশের উপযোগী জুতো বানানো যায়। কারন তাঁর তৈরী আমদানী করা জুতোগুলি পাঁচ থেকে সাত টাকা দাম। যা মধ্যবিত্তরা কেনার কথা সে সময় ভাবতেই পারত না। অধিকাংশ মানুষের কোন রোজগার ছিল না। হাতে টানা রিক্সাওয়ালার রোজগার ছিল কয়েক আনা। তাদের পা থাকত ফুলে আর কারো কারো পা ফেটে রক্ত পড়ত।

গঙ্গার পাড়ে বসে টমাস সাহেব একটি ডায়েরিতে আঁকিবুঁকি কাটতেন আর যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকতেন। ভাবতেন কি করে নিজের দেশ থেকে কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে গঙ্গার পাড়ে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে জুতো বানানো যায়। ইতিমধ্যে দুই ভাই এক বোন মিলে 'বাটা কোম্পানি' বানিয়ে মোরাভিয়ান টাউনে, চেক প্রজাতন্ত্রে তাঁর অফিস, কারখানা, কর্মীদের জন্য আবাসগৃহ ও অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন।

গঙ্গা বরাবর ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌঁছলেন কোন্নগর গ্ৰামে। চোখে পড়ল একটি পরিত্যক্ত তেলকল (হাতিরকুল)। তাঁর দূরদর্শী চোখ তখন দেখছে যন্ত্রপাতি আমদানি করে এখানে কারখানা স্থাপনের জন্য এটিই উপযুক্ত জায়গা।

তেলকলের আগে ছিল ড্যানিশদের ডক ও জাহাজ তৈরীর কারখানা। সেটি ভাড়া নিয়ে জলপথে কলকাতার গুদামঘর ও অফিসের আসবাবপত্র নিয়ে চলে এলেন কোন্নগরে। সাফসুতরো করে নূতন চেহারা দেওয়া হল। কিন্তু সমস্যা হল তাঁর দেশের জনাকয়েক সাহেবকে নিয়ে। ভাষা, খাদ্য বিনোদন কোনোকিছুই তাদের মনোমতো ছিল না। টমাস বাটা স্থানীয় লোকেদের নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ভিতরে ভলিবল কোর্ট, সুইমিং পুল বানালেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি সামলে মন্দা বাজারকে আবার চাঙ্গা করে তোলা ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে বোন অ্যানা বিয়ের পর অংশীদারত্ব থেকে সরে দাঁড়াল। সেসময় জাপান থেকে জুতো আমদানি ছিল ভারতে বেশী। সেইসঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল বেশ কঠিন। তা সত্বেও ভারতবর্ষে প্রথম বাটা কোম্পানির কারখানা গড়ে উঠল কোন্নগরে। শুরুতে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তারা যে সাদা চটি জুতো-বাজারে ছেড়েছিল তা সাধারণ মানুষ নিল না। কারন চটি পরার কোনো ধারনাই ছিল না জনসাধারণের। আর সাদা রং বিষাদের প্রতীক। পা থেকে খুলে যেতে থাকল দ্রুত হাঁটতে গেলে এবং সাদা রং তাড়াতাড়ি নোংরাও হয়ে যেত। ফলে কোম্পানি বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ল।

টমাস সাহেব নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন। স্থির করলেন দেশীয় চামড়া দিয়ে তৈরী করবেন জুতো। আবার এলো বাধা। গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা চামড়ার দুর্গন্ধের দোহাই দিয়ে কোম্পানির গেটে বসে পড়ল।

এরকম টালমাটাল অবস্থায় ১৯৩২ সালের ১২ই জুলাই আকস্মিক বিমান দুর্ঘটনায় টমাস বাটা নিহত হলেন। তাঁর ভাই আন্তোনিন বাটা কোম্পানির সমস্ত কার্যভার কাঁধে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। কারখানাটিকে কোন্নগর জনবসতি এলাকা থেকে সরিয়ে গঙ্গার ওপারে পুরো বনজঙ্গলে ঢাকা নুঙ্গীর কাছে গ্ৰাম নয় আস্ত একটা জঙ্গল কিনে সাফসুতরো করে একটা উপনগরী বানিয়ে ফেললেন - যা আজকের 'বাটানগর'। শুধু জুতো তৈরী নয় বিপনন, প্রশিক্ষণ এবং প্রতিনিয়ত বাজারের চাহিদা যাচাইয়ের মধ্যদিয়ে কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর মূলধন। কাকা এবং ভাইপো (টমাসের পুত্র) মিলে ধীরে ধীরে টমাস বাটার স্বপ্নকে ১৯৭৫-এ স্বর্ণযুগে নিয়ে গেলেন অজস্র সমস্যা মিটিয়ে। পৃথিবীর ৮৯টি দেশে ৯৮টি কোম্পানি, ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতোর উৎপাদন, ৫,০০০ স্টোর্স এবং ৯০,০০০ কর্মচারী নিয়ে ছিল বাটার বিশাল সাম্রাজ্য।

আবার ধাক্কা অসম প্রতিযোগীতার লড়াই। বাজার দখল করে নিল 'অ্যাডিডাস', 'নাইকে', 'রিবক'-এর মতো কোম্পানিরা। তাদের ঝাঁ চকচকে বিপননের কাছে ক্রমশঃ বাটা পিছিয়ে পড়তে থাকল। কিন্তু সে হার মানেনি। টমাস বাটার নাতি নবম পুরুষ এখনও কোম্পানির হাল ধরে রেখেছেন। সুইজারল্যান্ডে প্রধান কার্যালয় এর পাশাপাশি আফ্রিকা, এশিয়া প্যাসিফিক, লাটিন আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতবর্ষে রিজিওনাল অফিসগুলো চালু রেখেছেন। কোম্পানি এ বছরেও লাভ করতে চলেছে কয়েক'শ কোটি টাকা।

১৯৩৩ সাল থেকে দীর্ঘ ৭০ বছর চলার পর যে বাটার দোকান দিয়ে যাত্রা শুরু তা বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু জায়গাটির নাম থেকে গেছে কোন্নগরের 'বাটার মোড়'। সেই কারখানা আজও দাঁড়িয়ে আছে ঘন বন-জঙ্গলে ঢাকা ভগ্নপ্রায় জীর্ণ শরীর নিয়ে। গঙ্গায় নামার ঘাটটি ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

সকাল সন্ধ্যায় বহু মানুষ আসেন এই ভুতূড়ে বাড়িটি দেখতে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। বিষধর সাপখোপের ভয়। বিশালাক্ষীতলার ঘাট থেকে দেখা যায় দূরে শেওড়াফুলি শ্রীরামপুর গঙ্গার পাড়ে আকাশচুম্বি বাড়ি তৈরী হচ্ছে। কিন্তু এরকম একটি স্মৃতি চিহ্নকে সংরক্ষণ করে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা যায় না কি? আইনগত বাধা এবং বর্তমানে হাত বদল হয়ে নূতন মালিকানা নিয়ে কোনো তথ্য সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই।

ঐতিহাসিক মূল্যবোধের কথা ভেবে বাটা কোম্পানি যদি কোনোদিন এগিয়ে আসে তবেই তা সম্ভব। আমরা বহু ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ করতে পারিনি বা কিভাবে করতে হয় তা শিখতেও চাইনি। তাই এই বেহাল দশা সারা দেশজুড়ে। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাটা কোম্পানি যেন অজেয়। বর্তমানে এক শিল্পহীন রাজ্যের পক্ষ থেকে অসম্ভব দূরদর্শী টমাস বাটাকে জানাই নমস্কার।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।
আলোকচিত্রঃ লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।