নয় নয় করে এবাড়িতে পাঁচটি বছর কাটালাম। সত্যি বলতে কী আমার সাথে এক মুহূর্তের জন্যও এঁরা খারাপ ব্যবহার করেন নি। বাড়িওয়ালী দিদি তো আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। এবাড়িতে থাকাকালীন দিদির বড়ো মেয়ের বিয়ে দিলাম। বিয়ে দিলাম শব্দটা ব্যবহারের কারণ - পাত্র নির্বাচন থেকে শুরু করে এখানকার সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে খুব সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করলাম। ভদ্রলোক অর্থাৎ বাড়িওয়ালা ততটা চৌকস লোক নন, চাকরির সূত্রে অনেকের সাথে তাঁর পরিচয় আছে বটে কিন্তু সেটাকে কাজে লাগানোর মতো বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই। বাড়িওয়ালী দিদি তো একদিন বলেই ফেললেন - ভাই না থাকলে এ গুরুদায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের আগেই আমি ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন একটা বাসা নিলাম, কিন্তু সে বিয়ের সমস্ত আয়োজন এবং জোগাড়-যন্ত্র করে দিয়ে তবে আমি ছুটি পেয়েছি। ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম কারণ - টালির চালা দিয়ে জল পড়ে আমার বিছানার পুরোটাই ভিজে যায়, তাছাড়া ঘরটা প্রচণ্ড স্যাঁতসেঁতে সাপ এবং বিছের উপদ্রব। ঘর সারাইয়ের কথা বললে ওঁরা আমাকেই সারিয়ে নিতে বলেন। আমি যতই বলি সামান্য কটা টাকা টিউশনি করি এর সবটাই খরচ হয়ে যায়, সুতরাং আমার পক্ষে এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। দিদিকে বললে তিনিও জানান যে, মেয়ের বিয়েতে অনেক খরচ হয়ে গেছে, কিছুদিন বাদে সারাইয়ের ব্যবস্থা করে দেব। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসে, সুতরাং এবার তো ব্যাপারটা আরও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তখন বাধ্য হয়ে আমাকে বাড়ি পরিবর্তন করতে হয়। চলে আসার সময় ওদের চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি দেখেছি তা আমার অন্তরেও গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
প্রথম ভাড়াবাড়ীতেও কর্তা বাবু আর গিন্নিমা আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। এমন কিছু দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন এবং তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে দিয়েছি যে, ওঁরা পাড়ার সবাইকেই বলতেন - জয় আমাদের বাড়ির ছেলে, ভাড়াটিয়া হিসেবে ওকে আমরা দেখি না।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল—একবার বাড়িওয়ালা মেসোমশাই গভীর রাতে আমার কাছে এলেন এবং বললেন - বাবা রে, আমি তোকে একটা নতুন কাজের দায়িত্ব দেবো একটু করে দিবি?
আমি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। খানিকটা বিস্মিতভাবে ওঁর দিকে চেয়ে রইলাম। কী বলা যায় সেটা ভাবছিলাম। ভদ্রলোক আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন - আমি আমার ছেলেদের কেন এই দায়িত্ব দিতে চাইছি না তার কারণটা আমি তোকে পরে জানবো।
ব্যাপারটা কীসের সেটাই এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আমি বুঝতে পারছি না ভদ্রলোক ঠিক কী বলতে চাইছেন। চুপচাপ থেকে আগে আমাকেই দেখতে হবে উনি ঠিক কী বলতে চান। অতএব আমি চুপ করে থাকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ দুজনেই কোনো কথা না বলে একে অপরকে বুঝতে চাইছিলাম। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ভদ্রলোক বলতে শুরু করেন - আমার কাছে বেশ কিছু টাকা আছে, আমার ছেলেরা বা আমার স্ত্রী সেটা জানেনা। আমি এখন ওদের জানাতেও চাই না। কিন্তু টাকাগুলো আমার কাছেও রাখতে চাই না। আমি চাইছি অন্তত মাস ছয়েক টাকাটা তোর কাছে থাকুক। তারপর সময় বুঝে আমি চেয়ে নেবো।
কথাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠলো। আমার এই টাকা-পয়সার ব্যাপারে একটু ভীতি আছে, বিশেষ করে অন্য কারও টাকা। জানিনা টাকার পরিমাণ কত, পরিমাণ যাইহোক অন্যের টাকার দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে সত্যিই অসম্ভব। আমি তবুও জানতে চাইলাম - কত টাকা?
উনি বললেন - বেশি নয় লাখ দেড়েক হবে।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম - "বেশি নয় লাখ দেড়েক?" ওরে বাবা এত টাকা! আমি, মানে আমার কাছে রাখতে হবে?
- কেন সমস্যা কীসের?
- সমস্যা নয়? এতগুলো টাকা, আর বলছেন সমস্যা কীসের। আপনি বরং মাসিমাকে ব্যাপারটা জানান। টাকার ব্যাপারে যাকে তাকে বিশ্বাস করাটা ঠিক নয়। আমি এতগুলো টাকার দায়িত্ব কীভাবে নিই বলুন তো? যদি কোনোভাবে টাকাটা খোয়া যায় তখন আমি তো গভীর সমস্যায় পড়ে যাবো।
- তোর মাসিমাকে ব্যাপারটা জানানোর হলে নিশ্চয়ই জানাতাম। আর আমার ছেলেরা জানতে পারলে আমার ওপর অত্যাচার চালাবে। আমি ওদেরকে হাড়ে হাড়ে চিনি।
- ধরুন টাকাটা নিয়ে আমি উধাও হয়ে গেলাম। আমার তো কোনো চালচুলো নেই। আমাকে আপনি কোথাও খুঁজে পেলেন না৷ তখন আপনার যে তীব্র মনোকষ্ট হবে সেটা আপনি কীভাবে মেনে নেবেন?
- তখন বুঝবো টাকাটার একটা সদগতি হয়েছে। অন্তত একটা ভালোকাজে লেগেছে। আমার মদো মাতাল ছেলেরা আজেবাজে খরচ করে টাকাটা উড়িয়ে দেয়নি বরং যার প্রয়োজন তার কাছেই গেছে।
- তবুও আপনি আর একটু ভাবুন মেশোমশাই, অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। আমার ভীষণ ভয় করে। আমার জন্য আপনার কোনো ক্ষতি হোক এটা আমি চাই না।
কিছুক্ষণ আমরা উভয়ই চুপচাপ। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমি একঝলক মেশোমশাই-এর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বড়ো অসহায় সে মুখ, মনে হলো উনি আশাহত হয়েছেন। মুখটাতে ফুটে উঠেছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। আমার মনের মধ্যে তখন সুনামির আতঙ্ক। এতগুলো টাকা আমার কাছে দিবাস্বপ্নের মতো। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। মনে সাহস সঞ্চয় করে বললাম - এক কাজ করুন মেশোমশাই, যে কোনো একটা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাটা সেখানে গচ্ছিত রাখুন, প্রয়োজনে ব্যাঙ্কের পাশবুকটা আমার কাছে রেখে দিন। এতে আপনার উদ্দেশ্য পূরণ হবে। আর ব্যাঙ্কে টাকা থাকলে তা থেকে একটা ইন্টারেস্টও আপনি পাবেন। আপনি যখন প্রয়োজন মনে করবেন তখন টাকা তুলে নিতে পারবেন। এব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উনিই বললেন - তুই ঠিক কথাই বলেছিস বাবা। কিন্তু ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।
আমার প্রস্তাবটা মনে ধরেছে দেখে আমিও খুশি হলাম। মাথার উপর থেকে একটা বড়ো বোঝা নেমে গেল। তারপর একদিন ওনার সমস্ত ডকুমেন্টস সঙ্গে নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কে গিয়ে একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম। এই পদক্ষেপে আমার একসাথে দুটো বিপদ কেটে গেল। ওনার পরিবারের সদস্যদের কিছু বলার থাকলো না। আমিও নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে রইলাম। উনি আমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। বললেন - এখনো পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা কারও কোনো প্রলোভনে পা দেননা। তাই বোধহয় পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর আছে।
ওনার বাড়ি থেকে চলে আসার কিছুদিন আগেই আমি ওনার পাশবই এবং দুই একটা গচ্ছিত জিনিস ওনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসি। তখন বুঝতে পারছিলাম আমার চলে আসাতে উনি মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু কী আর করা যাবে। আমার সংগ্রামী জীবনের গতিপথ অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ। সেই পথে চলার জন্য আমাকেই আমার পরিকল্পনা করতে হবে। এখন সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে আমাকে পৌঁছাতে হবে। ওনার ওই টাকা দিয়ে আমি হয়তো আমার জীবনকে নতুন করে সাজাতে পারতাম, অনেক স্বাচ্ছন্দ্য আসতো আমার জীবনে, কিন্তু নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হতো। আমি চেয়েছি যতদিন বাঁচবো সৎভাবেই বাঁচবো, তাতে বাঁচার মতো বাঁচা হবে। আমার বাবা আমাকে সেভাবেই চলতে শিখিয়েছেন। তাঁকে আমি কীভাবে অসম্মান করব।
(ক্রমশ)