সন্ধ্যের পর থেকে এদিকের গাঁয়ে গঞ্জে পায়ের শব্দ এমনিতে বেশ কমতে থাকে। অন্ধকার যত গাঢ় হয় এক এক করে দোকানের ঝাঁপ নেমে যায়, সেদিনের মতো চোখ বোজে। এর মধ্যে নীলমণি মালির চায়ের ঝুপড়িটাই টুনি নদীর পাড়ে শুধু জেগে থাকে। আখার পাশে বাবলা কাঠের জলচৌকিতে বসে ফি-পারানি গুনতে গুনতে ঘড়ির কাঁটা সরে, সময় নড়েচড়ে।
একে একে খদ্দের নিবু নিবু। আঁচ পড়তে থাকে, দু'চারটে পোড়া গুল চাপিয়ে একবার তলাটা খুঁচিয়ে দেয় নীলমণি। ভুর ভুর করে মরা আঁচে আগুনটা শেষ হবার আগে লকলক করে ওঠে। রাত দুটো, তিনটে করতে করতে কখন যে ওদিকে আবার আবির রাঙা হয়ে নদীর জলে চিকচিক করে ওঠে ভোর, নীলমনির ঘড়ি থামেনা।
ঝুপড়ির সামনে জল ছিটিয়ে ঝাঁটা মারতে মারতে দিনটা ফর্সা হতে শুরু করে। তড়িঘড়ি ঘাটে নেমে ক'টা বাসন মাজা শেষ করে এক দমে তিন ডুব মারে। তারপর প্রতিদিনকার মতো বিড়বিড় করতে করতে কপালে পটাপট আঙ্গুলের কয়েকটা ঠোকা। মঙ্গলকামনা।
বাবার পুরোনো ডায়েরীর পাতা থেকে এক নিঃশ্বাসে পড়া ক'টা লাইন। মনে হয় সময়টা যেন ডায়েরীর পাতায় সেই অজানা পাইখালি গ্রাম আর তার কাঁধ বেয়ে বেয়ে চলা টুনি নদীর গায়ে এখনো থেমে আছে।
ছেচল্লিশ বছর পর, সেই গ্রামের আদি পোষ্টাপিস বাড়ি খুঁজে বার করতে বেশ বেগ পেতে হল। সে বাড়ির উঠোনে এখন মোবাইল টাওয়ার। সেই পোষ্ট অফিস বাড়ির মুখোমুখি এক তিনতলা বাড়ি, ডায়েরীর বর্ণনা অনুযায়ী এখানে ছিল মন্টুবাবুর তারকাঁটা ঘেরা ফুল-ফলের বাগান। যেটা না বললেই নয়, তা হল সেই ধূলোমাটির পথ বেশ আমূল পাল্টে গেছে বিটুমিন মোড়া সড়কে। গাঁয়ের রূপে লেগেছে শহুরে আভিজাত্যের মলাট। তাই এ আগন্তুকের প্রতি আজকের ব্যস্ত জনপদের কোনো জিজ্ঞাসা ভেসে উঠতে দেখলাম না। ব্যস্ততার দৌড় গাঁয়ে শহরে কোনো ফারাক রাখেনি।
তখনকার স্থানু শান্ত গ্রাম এখন চঞ্চল কর্মমুখর। যত্রতত্র ই-রিক্সা আর রকমারি বাইকের ছুটোছুটি। ডায়েরীতে প্যাডেল করা রিক্সার অবশ্য কোনো উল্লেখ দেখিনি, সাইকেলের উল্লেখও সেরকম বেশ কম, প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ডাক পিয়নের সাইকেল গ্রামে চলত সেটা ঘুরে ফিরে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, খাম, পোষ্টকার্ড বিলির সাথে মিলেমিশে বাবার ডায়েরীতে ছবি হয়ে আছে।
দুই দালান বাড়ির মাঝখান বরাবর একটা সরু ঢালাই রাস্তা। বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখা পেলাম সেই রমনীয় টুনি নদীর। জল আছে। গাঢ় রঙ। ডিঙি ভেড়ানো আছে দু'একখান, কিন্তু নৌকা নেই। খানিক দূরেই নজরে এল উঁচু পাকা সাঁকো। দুই গ্রাম জুড়ে গেছে সড়কে, বাস রাস্তায়, তাই বুঝি নৌকার ছুটি। ঘাটে নামার কংক্রিটের সিঁড়িটা নদীর জলে নেমে খানিক ডুবে আছে। এক পা এক পা করে নেমে জল ছুঁতেই নীলমনির সেই ডুব দেওয়ার গল্প মনে পড়ে গেল।
ভেটুল গাছের গোড়ায় সিমেন্টে বাঁধানো ধাপি।
ধাপিতে এসে বসে ডায়েরীর পাতাগুলো ছবির মতো যেন চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাবার ডায়েরীর ছবি যদি হয় পাইখালি গ্রামের তাহলে নীলমণি মালি তার এক মস্ত জুড়ে থাকা তামাটে মানুষ, তখনকার দেশ-দেশান্তরের খবরের হরকরা। তাই সময় নষ্ট না করে নীলমণিকে খুঁজে বের করার তাগিদে উঠে পড়লাম।
ঘাটের কাছে কোথায় যেন ছিল নীলমণির দোকান। সারা দিনরাত যার দোকানে ঝাঁপ পড়ত না। একমাত্র রাতবিরেতে টেলিগ্রাম প্রাপকের ঠিকানা খুঁজে দিতে সদাজাগ্রত নীলমণির ডাক পড়ত। কোনদিকে, কোথায় হতে পারে!
একটু এগিয়ে বাঁদিকে বাঁকের মুখে এক মুড়ি মশলা চানাচুরের দোকানীর কাছে এগিয়ে গিয়ে নীলমণির কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে, ভারি অদ্ভুত, তার জ্ঞানে এমন নাম শুনেছে বলে মনেই করতে পারল না।
সারি সারি নদীর ঘাটমুখো কয়েকটি দোকান। দোকানীরা চেহারায় সব নবীন, নীলমণির খোঁজ দেবার মতো কাউকেই মনে হলো না।
বেলা পড়েছে, রকমারি কসমেটিকস্-এর দোকানে হলদে আলোয় চকচক করছে গয়নাগাটির পসরা। এক মধ্যবয়সিনী দোকান সামলাচ্ছেন।
সাহস করে তার কাছে নীলমণি মালির কথা তুলতে উল্টো প্রশ্ন - "কোথায় থেক্যে আসছেন?"
নাম পরিচয় জানার পর সে বলল, গোপাল মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করলে ও বলতে পারবে।
যাইহোক, গোপালে মাষ্টারের হদিশ জেনে, আবার বড় রাস্তায় পৌঁছলাম। তিনকোনা রাস্তার মাঝে এক মন্দির। শিবলিঙ্গ পূজিত। পাশেই একতলা বাড়ির সামনের বারান্দা লাগোয়া ঘরে প্রাইভেট টিউশনি করে গোপাল।
বারান্দায় প্রচুর জুতো। টপকে টপকে দরজায় উঁকি মেরে বললাম, "গোপাল..."
- হ্যাঁ বলুন। আপনার ক্যান্ডিডেট কে?
বললাম, না তা নয়, একটু কথা আছে। দু'এক মিনিট।
হঠাৎ নীলমনীর নাম শুনে তার মুখের চেহারাটা কেমন পাল্টে গেল।
- কে হন আপনি?
- কেউ না।
- তাহলে যান।
- না না উনি কেমন আছেন, কোথায় থাকেন, একবার যদি দেখা করতে পারি -
ব্যস্ত মুখে চোখে, বলল, "দেখুন, এখন আমি ক্লাসে বসেছি, কালকে সকালে একবার আসুন না।"
বললাম, "অনেক দূর থেকে এসেছি, দয়া করে একবার যদি..."
শুনে গোপাল একটু চিন্তায় পড়ে গেল যেন। উঠে এসে বারান্দার পাশ থেকে একটা সাইকেল নিয়ে এল। ঝট করে সাইকেলে উঠে বসল। পেছনের ক্যারিয়ারে বসতে বলল, উঠে পড়লাম সাইকেলে।
বেশ খানিকটা, প্রায় হাফ কিলোমিটার এসে একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে সাইকেলটা থামল। তারপর জোরে জোরে গোপাল ডাকল, "জাহির কাকা, জাহির কাকা...।"
অন্ধকারের আঁশ ছাড়িয়ে ঋজু চেহারার জাহির কাকা বেড়িয়ে এসে মুখটা সামনে ঝুঁকিয়ে গোপালকে দেখে বললেন, "ও তুমি। আসো ভিতরে। বিশু কম্পান্ডার সকালে এসে বারবার বুলছিলো হাসপাতালে লিয়ে যেতে। কিন্তু নীলু ভাই আমার কুনো কথা শুনে না। আওয়াজখান গলা থেকে একিবারে সরে গিছে বুঝলা। শুধু ঘড়ঘড়ানি শুনা যায়, ব্যস, দু'কুড়ি বচ্ছর ধরে ওই এক ধুধারুয়ারেই শুধু খুঁজে।"
'ধুধারুয়া' শব্দটা শুনতেই আমার সারা গায়ের রক্তমাংসের আনাচকানাচে সাইক্লোন বয়ে গেল।
এটা তো ঠিকই, পরিচয় না দিলে, এত বছর পর কারোরই কি আজকের ধুধারুয়াকে চেনা সম্ভব!
জাহির কাকা আমার দিকে তাকিয়ে গোপালকে শুধালেন, কে আমি। তারপর বলতে থাকলেন। চোখ ভরা তার জল। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তো ব্যাটা চলেন আপনাকে ভাই-এর বিছনার ওখেনে লিয়ে যাই।"
তাকে অনুসরণ করে পাশের ছোট্ট ঘরে গিয়ে বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া নীলমনির তক্তপোষের পাশে একটা জলচৌকিতে বসলাম। কেউ একটা ঘরে ঢুকেছে, ফ্যালফ্যালে দুটো চোখ, অস্ফুট, ঘড়ঘড়ে গলায় তার প্রশ্ন, "জাইর রে, ধুধারুয়া আসব কিনা খবর পালি? মাষ্টার সাহেব আমারে যাওনের আগে কইসিলো, পোলাডা আইব। পোলাডা বড়ো হইয়া ঠিক আইব।"
তার শীর্ণ দলা পাকানো হাতটা আমার হাতে তুলে নিয়ে বললাম, "এখন কেমন আছো নীলু কাকা? কোথায় তোমার কষ্ট? আমাকে একটু বলো।"
"তুমি কেডা রে? কার পোলা? চোখে তো দেহিনা, মাষ্টার সাহেব রে চিনো। কই থাকো।"
তাকে ধমক দিয়ে বেশি কথা বলতে বারণ করে জাহির কাকা বললেন, "আগে শুনেন। পরে কথা কবেন।"
একমুখ অসংবৃত দাঁড়ি, সারা গায়ে লাল লাল ছোপ। চোখে দৃষ্টি নেই। নীলু কাকাকে এভাবে দেখে মনের জোর হারিয়ে ফেলছিলাম। খানিকটা এগিয়ে বসে তাঁকে তাঁর ধুধারুয়ার কথা বলতে শুরু করলাম। তাঁর প্রিয় ডাকমাষ্টার সাহেব আর নেই আর সেই দিদিমণিও নেই শুনে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে পড়া শরীরটা কেমন ঝাঁকিয়ে উঠল। দুটো চোখ অস্থির নাড়াচাড়া করছে, এমন অবেলায় আমার কথায় যেন নীলু কাকা বহুদিনের স্বপ্ন পূরণের উত্তেজনা অনুভব করে অদ্ভুত আপ্রাণ আওয়াজ করলেন, "ধু-ধু-ধা..."
পাশে দাঁড়িয়ে জাহির চাচা নীলু কাকাকে থামিয়ে আমার হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "বাপ আমার তুই একটা কুনো ব্যবস্থা করে দে ধন। উয়ার শরীলের বেথা বেদনা আর দেখা যেছেনা যে। এ বুড়োটার যন্তন্না আমি আর লিতে পেছিনা।"
কোন এক ডাক্তারবাবুকে এনে দেখানোর ব্যবস্থা গোপাল করবে ঠিক হল। জাহির কাকার হাতে চিকিৎসার কিছু খরচ তুলে দিয়ে নীলু কাকাকে বললাম, "চিন্তা কোরোনা, তুমি একদম ভালো হয়ে যাবে। আমি আবার আসব।"
উঠে দাঁড়ালাম, গোপালকে সাথে নিয়ে পাইখালির বড়ো রাস্তার মোড়ে পৌঁছে ফিরতি বাসের পথে তাকিয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। গোপাল সান্ত্বনা দিল, বলল, "এতো ভাববেন না। নীলুকা'র ধুধারুয়া যখন এসে গেছে, আর কোনো চিন্তা নেই দাদা।"
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।