গল্প ও অণুগল্প

অমানিশা



অচিন্ত্য সাহা


১৪ই আগস্ট। চারিদিকে আজ রাত দখলের লড়াই চলছে। রাত যত গভীর হচ্ছে মানুষের কণ্ঠস্বর তত জোরালো হচ্ছে। আর জি কর হাসপাতালে পড়ুয়া ডাক্তার চিকিৎসক তিলোত্তমাকে ধর্ষণ এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার বিচার চেয়ে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। কলকাতার সাথে গোটা পশ্চিমবঙ্গ এমনকি পৃথিবীর প্রায় ছাব্বিশটা দেশের দুই শতাধিক শহরে মেয়েরা রাত দখলের ডাক দিয়েছেন। তমালিকা মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল। চারিদিকে ঘোর অমানিশা। অন্ধকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজ সবার সাথে না হলেও একাকী সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়েছিল। কোনো গাড়ি না পেয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল। কিছুটা চলার পর অন্ধকার অনেকটা সয়ে এসেছে। এখন আবছা আলোয় পথের রেখা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওদের পাশের বাড়ির কমলকাকু ফোনে জানিয়েছেন - "যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে আয়। তোর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পাড়ার কোয়াক ডাক্তার রবিকে ডাকা হয়েছিল। সে এসে বলে গেছে এই কেসটা তার ক্ষমতার বাইরে"।

ম্যাচপোঁতা গ্রামে বিপদে আপদে রবিই একমাত্র ভরসা। প্রথাগতভাবে ডাক্তারি পাস না করলেও চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রাথমিক জ্ঞান ওর কম নয়। ছোটোখাটো সমস্যা হলে ও অনেকটা সামলে দিতে পারে। পলিটিক্যাল সায়েন্সে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার সময় কলকাতার একটা প্যারা মেডিকেল কলেজ থেকে আর. এম. পি. কোর্স করে নেয়। কেননা ও জানে চাকরির বাজারে লাইন দিয়ে দাঁড়ালে ওর সারাটা জীবন কেটে গেলেও চাকরি জুটবে না। চাকরির ফর্ম ফিল-আপ করতে করতে পকেট শূন্য হয়ে যাবে, সু-র তলা ক্ষয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারি শিখে নিলে ওর গ্রামে বসেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবে। ওদের গ্রাম থেকে নিকটবর্তী হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার। লছিমন, অটোরিকশা, ভ্যান বা গরুর গাড়ি ছাড়া কোনো নিয়মিত যানবাহনের ব্যবস্থা নেই যাতে কেউ অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে একটা ছোটোখাটো চেম্বার করে বসলে সহজেই ওর পসার জমে যাবে। বছর পাঁচেকের মধ্যেই রবি যেভাবে সাফল্য পেয়েছে তাতে সহজেই অনুমান করা যায় যে ওর ধারণা একেবারে সঠিক ছিল। এখন ওর যথেষ্ট নাম হয়েছে। রবি সত্যি সত্যিই এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ডাক্তার। গ্রামের মানুষ রবিকে ভগবান মনে করে। ওর রোগনির্ণয় এবং ওষুধ নির্বাচন ক্ষমতা দেখে অনেক পাস করা ডাক্তারও বিস্ময় প্রকাশ করেন।

তমালিকা সাহসে ভর করে এগিয়ে চলেছে। শৈশবে পিতৃবিয়োগের পর মায়ের অভিভাবকত্বে বেথুয়াডহরীর জে. সি. এম. উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তমালিকা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করার পর নীট-এ ভালো ফল করার সুবাদে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায়। বর্তমানে এস. এস. কে. এম. হাসপাতালে চেস্ট মেডিসিন বিভাগে জুনিয়র ডাক্তার পদে কর্মরত। এই বছরটা শেষ হলেই তমালিকা একজন পরিণত ডাক্তারের স্বীকৃতি লাভ করবে। আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।

এই রাস্তা দিয়েই প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করত। গ্রামের মানুষগুলোর মতো এই পথও তার কাছে কত আপনার। এখন যে তমালিকা ডাক্তারি পড়ছে সেটা গ্রামের সবাই জানে। মাঝে মধ্যে বাড়ি ফিরে বিনা পয়সায় রোগী দেখে ওষুধ দেয়, ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে সেটাও দিয়ে দেয়। তাই ও যখন গ্রামে ফেরে তখন রীতিমতো উৎসব লেগে যায়। মায়ের কাছে শুনেছে বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার কিন্তু আর্থিক অনটনে সেটা সম্ভব হয়নি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য মা তাকেই নির্বাচন করেছেন।

কমলকাকুর ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তমালিকা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। তখন রাত সাড়ে ন'টা। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। বেথুয়াডহরি পৌঁছাতে দুটো আড়াইটে বাজবে। তখন বাড়ি পৌঁছানোর জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। কমলকাকুকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করলে ভালো হতো। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সব ভুলে গেছে। এদিকে আর. জি. কর হাসপাতালে ডাক্তারদিদির ওপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু হয়ে গেছে মেয়েদের রাত দখলের লড়াই। এই ঘটনাটাকে ঘিরে যে উন্মাদনা তৈরী হয়েছে তা দেশ-বিদেশের প্রতিটি মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। গতকাল পি. জি. হাসপাতালের ভিতর জুনিয়র ডাক্তার এবং পুলিশের মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। হাসপাতাল অভ্যন্তরে জুনিয়র ডাক্তার সৌভিক ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু ডাক্তার কর্মবিরতির কথা ঘোষণা করে। এর ফলে পুলিশের সাথে প্রথমে তর্কাতর্কি তারপর হাতাহাতি এবং সবশেষে পুলিশ এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে। ফলে সৌভিক সহ দু'জন জুনিয়র ডাক্তারের মাথায় চোট লাগে। আঘাত ততটা গুরুতর না হলেও এই ঘটনায় অধিকাংশ জুনিয়র ডাক্তার ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে পুলিশের দল ওখান থেকে পালিয়ে যায়। বর্তমানে হাসপাতালের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতাল অভ্যন্তরে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে। তাদের দাবি এই ঘটনার জন্য পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এই আন্দোলনে তমালিকা সকাল থেকেই ছিল তাই তার ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সন্ধ্যার পর ওকে ডিউটিতে পাঠানো হয়, কিন্তু মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ওর রুমমেট তপতীকে সংক্ষেপে বিষয়টা জানিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়েছে। বেথুয়াডহরি স্টেশনে নেমে দেখতে পেয়েছে কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তার দু'দিকে দাঁড়িয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বলছেন - "উই ওয়ান্ট জাস্টিস", "তোমার স্বর, আমার স্বর, জাস্টিস ফর আর. জি. কর" - সহ আরও নানা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত। তমালিকা অসম্ভব জোর পেল মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখে। রাত পোহালেই ১৫ই আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা দিবস। মানুষ সেসব ভুলে পথে নেমেছেন, যেভাবে হোক এই অন্যায়ের প্রতিকার করতেই হবে। অপরাধীকে গ্রেফতার করে তার উপযুক্ত সাজা না দিয়ে পুলিশ প্রশাসন তাকে আড়াল করতে চাইছে। এর পিছনে নিশ্চয় উচ্চস্তরের কোনো ব্যক্তি জড়িত তাই সমস্ত ঘটনার সত্যতা তুলে না ধরে তাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে তমালিকা একা একা পথে নেমে পড়ল। সবার সাথে না হলেও আজ ওর একাকী রাত দখলের লড়াই।

একটা সময় চোর-ডাকাতের উপদ্রব এতটাই ছিল যে সন্ধ্যের পর এই রাস্তা দিয়ে লোকজন আসা-যাওয়া করত না। কিন্তু এখন সেসব দিন নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত প্রায় তিনটে বাজে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যাবে। নামাজ পড়ার জন্য অনেকেই মসজিদে আসবেন। মাঝে মধ্যে দুই একজনের কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সবাই একসাথে মিলেমিশে বাস করেন। কেউ কারোর সাথে বিবাদ করেন না। বরং বিপদে আপদে সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মায়ের কাছে শুনেছে দু'হাজারের বন্যার সময় বাবার সাথে রহিম চাচা, ফকর উদ্দিন, কমলকাকু, ফাদার ডি'সুজা, মাদার এলিনা, সিস্টার ডেভিয়া একসাথে কাজ করে গ্রামের মানুষকে রক্ষা করেছেন। মসজিদ থেকে বারবার ঘোষণা করে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। চার্চ এবং মসজিদ চত্বরে লঙরখানা খুলে বন্যাদুর্গতদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ অঞ্চলে মানুষের চেয়ে খরিসের উৎপাত খুব বেশি। তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়। টর্চের জোরালো আলোয় পথ চলতে চলতে দুই একটা শেয়াল চোখে পড়েছে। এসব সামান্য বিষয়কে তমালিকা খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। ভূত-প্রেতে ওর বিশ্বাস নেই। ও জানে মানুষের চেয়ে ভয়ংকর আর কেউ নেই। সেজন্য সে তৈরী আছে। দু'চারজনকে মেরে মাটিতে আছড়ে ফেলার ক্ষমতা ওর আছে। স্কুলে পড়ার সময়ই ওরা কয়েকজন বন্ধু মার্শাল আর্টে ট্রেনিং নিয়েছিল। এখনো নিয়মিত প্র্যাকটিস করে, কেননা পথে চলতে গিয়ে কখন কোন বিপদ আসে বলা তো যায় না। খবরের কাগজ খুললেই ''মেয়েদের উপর অত্যাচার আর ধর্ষণ করে খুন" হামেশাই চোখে পড়ে। এসব দেখেশুনে মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে গেছেন। আর. জি. করের ঘটনা মানুষের মনকে আরও বিষিয়ে দিয়েছে। ট্রেনে বসে অনেক যাত্রীকে এ বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে শুনেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে অনেক পূজা কমিটি সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছেন। সরকার অবশ্য এদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ করার কথা ঘোষণা করেছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী পথে নেমে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেছে। একজন নারী কীভাবে গোটা সমাজটাকে রাতারাতি বদলে দিতে পারেন তার দৃষ্টান্ত এর আগে যুবসম্প্রদায় দেখেনি। তাদের উদ্যোগ ও সহযোগিতা অবশ্যই মনে রাখার মতো।

- কে যায়? এত রাতে...

- আমি গো আমি, রহিম চাচা।

রহিম চাচা পাটকেবাড়ী অঞ্চলের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। অশীতিপর বৃদ্ধ হলেও এখনো তাঁর চাবুকের মতো টানটান শরীর। পাটকেবাড়ী হাইস্কুলের পাশেই তাঁর বাড়ি। পাটকেবাড়ী, ম্যাচপোঁতা, ধনঞ্জয়পুর এবং আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এখনো তাঁকে মুরুব্বি জ্ঞান করেন। তিনি আজও সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো রাতবিরেতে মানুষের আসা-যাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখেন। তাঁর চোখ এড়িয়ে কেউ কোথাও যেতে পারে না।

রহিম চাচা বেরিয়ে আসেন - তমা মা, এত রাতে তুই একা কোথায় যাস?

- বাড়ি থেকে কমলকাকু ফোন করে জানিয়েছেন যে মা নাকি খুব অসুস্থ। তাঁর ফোন পেয়েই আমি ডিউটি ফেলে ছুটে এসেছি।

- তাই বলে স্টেশন থেকে এত রাতে একা একা!

- চাচা আমি তোমাদের মেয়ে। এই অঞ্চলে এমন কারও বুকের পাটা আছে যে আমার ক্ষতি করে?

- না, তা নেই। কিন্তু...

- কিচ্ছু ভেবো না চাচা। এখন বাইরের ভয় থেকে ভিতরের ভয় অনেক বেশি। আর. জি. করের ঘটনা তো নিশ্চয় শুনেছ, একজন লেডি পড়ুয়া ডাক্তার তাঁর কর্মস্থলে সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে থাকা সত্বেও নির্মমভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং তাঁকে খুন করে সেই মৃতদেহকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ভাবতে পারছো চাচা প্রকাশ্য রাস্তায়ও এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে না। তোমাদের সময় যা ছিল এখন ঠিক তার বিপরীত।

- চল মা আমি তোর সাথে যাই। তোর মা'কেও দেখে আসা যাবে। অনেক দিন ওখানে যাওয়া হয়নি।

- চাচা, তোমার বয়স হয়েছে। তাছাড়া...

- বয়সের কথা বলিস নে মা। এই বুড়ো হাড়ের ভেলকি তো দেখিসনি। এখনো লাঠি হাতে দশজনের সাথে লড়তে পারি।

তমালিকা মায়ের কাছে শুনেছে রহিম চাচার বীরত্বের কাহিনি। হাতে লাঠি নিয়ে রহিম চাচা আগে আগে চললেন। তমালিকা আর কথা না বাড়িয়ে রহিম চাচাকে অনুসরণ করল।

মিনিট পঁচিশের মধ্যে ওরা গন্তব্যে পৌঁছে গেল। তমালিকা দৌড়ে মায়ের ঘরে গেল। স্বাতীকাকিমা মায়ের কাছেই বসেছিলেন - এই তো মা তমা এসে গিয়েছিস। আর কোনো চিন্তা নেই।

তমালিকা মায়ের কাছে গিয়ে প্রথমে পালস চেক করে, তারপর রক্তচাপ পরীক্ষা করে, চোখের পাতা তুলে দেখে - মোটামুটি সব ঠিকই আছে। এবার স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্ট, লাঙস্ এবং বুক-পিঠ পরীক্ষা করে। বুঝতে পারে হার্টের একটু সমস্যা আছে। স্বাতী কাকিমা বলতে থাকেন - বিকেল থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তোর কাকু জিভের নীচে সরবিট্রেট দেবার পর শ্বাসকষ্ট কিছুটা কমে। তখন রবিকে ডেকে এনে পরীক্ষা করান। রবি তার অক্ষমতার কথা জানালে বাধ্য হয়ে কাকু তোকে ফোন করেন।

- না না কাকু তো ঠিক কাজই করেছেন। মা এখন মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে একটু অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।

অক্সিজেনের কথা কানে যেতেই রহিম চাচা বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে বললেন - মা তমা, অক্সিজেন লাগবে?

- হ্যাঁ চাচা। কিন্তু তুমি... মানে... অক্সিজেন... আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

- বোঝাবুঝি পরে হবে। আমি আসছি।

রহিম চাচা বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই তিনি কোথা থেকে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে হাজির করলেন - এই নে মা। বৌমাকে অক্সিজেন লাগিয়ে দে। ওতে রেগুলেটরও আছে।

- কিন্তু চাচা, এই ভোরবেলায় তুমি এটা কোথায় পেলে?

- সব বলছি মা সব বলছি। তুই আগে ওটা মায়ের জন্য ব্যবহার কর। তারপর সব বলব ক্ষণ।

তমালিকা সময় ব্যয় না করে মায়ের নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা চোখ মেলে তাকান। কমলকাকু, স্বাতীকাকিমা, রহিম চাচা সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

- মা তুমি ঠিক আছো তো? কোনো চিন্তা নেই। আমি এসে গেছি।

মায়ের দু'চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট কমে আসে। কিছুক্ষণ পর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।

রহিম চাচা বলতে থাকেন - করোনার সময় মানুষকে বাঁচাতে যখন অক্সিজেনের অভাব দেখা গিয়েছিল তখন পাটকেবাড়ির কোয়াক ডাক্তার অশোক অনেক চেষ্টা করে কৃষ্ণনগর থেকে পাঁচটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসে। ফলে এই পাঁচটা গ্রামের একজনও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি। অশোক তখন নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে।

- সেই সিলিন্ডার এখনো...!

- হ্যাঁ। অশোক মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায়। এই তো গেল সপ্তাহে দুটো সিলিন্ডার ঠিক করা হয়েছে। পাঁচটা সিলিন্ডারের মধ্যে দু'টো তোর মায়ের টাকায় কেনা।

কথার মাঝে কখন যে মা উঠে বসে পড়েছেন তা কেউ খেয়াল করেনি।

- হ্যাঁ মা। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তুই যখন এসে পড়েছিস তখন আমার আর কোনো চিন্তা নেই। তোর রহিম চাচার হাত ধরে আমার এই গ্রামে আসা। ওই মানুষটি একজন সত্যিকারের মানুষ। আজকের এই অমানিশার যুগে এক ঝলক ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো অমলিন।

মায়ের কথা শেষ হবার সাথে সাথে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। রহিম চাচা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন - মা তমা, বৌমা, আমি আসি।

- আচ্ছা চাচা, এসো।

আজানের ধ্বনি শেষ হতেই পূর্ব দিকের আকাশ রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। তমালিকা মনে মনে বলে - ঘোর অমানিশা কেটে নতুন ভোরের আবির্ভাব ঘটল। এবার সত্যি সত্যি তিলোত্তমার অপরাধীরা জনরোষের প্রখর তাপে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। প্রভাত সূর্য রক্তাক্ত আলোকে সেই বার্তা ঘোষণা করছে।

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।