গল্প ও অণুগল্প

শঙ্কর পালের ঘোড়া



সঞ্জয় মুখার্জি


শীত আসছে। বেশ একটা আদুরে অনুভূতি। তখনও শরীরে সোয়েটার ওঠেনি, মাথার ওপর ফ্যান চলছে হালকা স্পিডে কিন্তু মনে অদ্ভুত এক দোলাচল। চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে এক একটা নানান সাইজের ঘুলঘুলি। সেগুলোতে চোখ লাগালে আমি দেখতে পাই পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে গেছে ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন খেলা। ক্যাম্বিস বলের ব্রহ্মতালুর ওপর সপাটে ব্যাট নেমে এলো আর বলটা উড়ে গিয়ে পড়ল নিমাইবাবুর মুদিদোকানের টিনের চালে। নভেম্বর এসে গেল। শেষ সপ্তাহে বা ডিসেম্বরের শুরুতে অ্যানুয়াল পরীক্ষা। পনেরো কুড়ি দিন পরেই রেজাল্ট আউট। এই মাঝের গ্যাপটুকুর জন্যেই সারা বছর অপেক্ষা। শীতের দিনগুলোতে চুটিয়ে খেলার মোক্ষম সুযোগ। হাতে রইল গোটা জানুয়ারি।

জীবনানন্দর প্রিয় ঋতু হেমন্ত। আর এই হেমন্তেই কালীপুজো। পটকা আর বোমের আওয়াজ ছোটবেলা থেকেই আমি তেমন পছন্দ করতাম না। কালীঠাকুর দেখতে বেরিয়ে খুব কাছে কেউ চকলেট বোম বা কালীপটকা ফাটালে আমি মাঝেমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। মানুষ বাজি ফাটিয়ে শব্দ করে কী আনন্দ পায়, সেটাই এক বিস্ময়। সেই সময়ে কালীপুজো আসার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো বোমা আর পটকার আওয়াজ। দিন যত এগোয় আওয়াজ তত বাড়ে। সব শেষে পুজোর দিনে একদম মারকাটারি কাণ্ড। ফাটছে তো ফাটছেই, কোথাও না কোথাও, ননস্টপ। আমি ছোটমামার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে দু'কানে আঙুল গুঁজে হেঁটে চলেছি। এই দৃশ্যের কথা আজ মনে পড়লে খুব হাসি পায়। ডেসিবেল শব্দটা তখন আমার অজানা। রাত একটু বাড়লে ছোটমামা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা উলের টুপি বার করে আমাকে পরিয়ে দিত। হেমন্তের রাতে হিম পড়ে। তার জন্যেই এই আয়োজন। কিন্তু এটা আবার আমার ঠিক পছন্দ হতো না। কিছুক্ষণ পরেই টুপি খুলে ফেলতাম। তখন কানদুটো বেশ গরম আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটার পর একটা প্যাণ্ডেল ঘুরছি আর মোলায়েম ঠাণ্ডা হাওয়া জানিয়ে দিচ্ছে শীত আসছে। আমার প্রিয় ঋতু।

ডিসেম্বরে অফিস থেকে ফিরে, এক প্রস্থ চা খেয়েই বাবা উত্তর দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিত। বলত উত্তুরে হাওয়া গায়ে লাগলেই শরীর খারাপ হবে। কিন্তু হাওয়া না লাগিয়েও মাঝেমাঝে শুরু হয়ে যেত খুকখুকে কাশি। সেটাকে ম্যানেজ দেবার জন্যে ছিল হোমিওপ্যাথির অব্যর্থ বড়ি, ব্রাওনিয়া ৩০। ভর্তি হয়েছিলাম স্থানীয় স্কুলে, হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট। ক্লাস ফাইভ অবধি মর্নিং সেশন। সিক্স থেকে ডে। আমরা রাত সাড়ে দশটা, এগারোটার মধ্যে খাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়তাম। বাবা উনুনে গরম জল তৈরী করে একটা ফ্লাস্কে রেখে দিত। তারপর টেবিলঘড়িটায় অ্যালার্ম সেট করত ঠিক পাঁচের ঘরে কাঁটা বসিয়ে। একে শীতকাল তার ওপর ভোর পাঁচটা। লেপ থেকে বেরোতে ইচ্ছেই করত না। অ্যালার্ম বেজে থেমে যাবার পরেও মটকা মেরে পড়ে থাকতাম। অনেক ডাকাডাকি করে আমাকে তুলতে হতো। প্রেয়ার শেষ হলে সাতটা থেকে প্রথম ক্লাস। আমি ঘুম থেকে গড়িমসি করে ওঠার পর বাবা ফ্লাস্কের গরম জলে অল্প ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে ঢেলে দিত একটা প্লাস্টিকের মগে। তারপর বিনাকা পেস্টের টিউব থেকে মাজন বার করে ব্রাশে মাখিয়ে এক রকম আমার মুখে গুঁজেই দিত। মাঝেমাঝে বলত, এই দ্যাখ এবার প্যাকেট থেকে কি বেরিয়েছে। দেখলাম একটা নীল রঙের রবারের শামুক। কিন্তু শামুক আমার আরও চারটে আছে। তাই তেমন খুশী হতে পারলাম না। বরং জেব্রা বা জিরাফ বেরোলে ভালো লাগত। নিদেনপক্ষে একটা রামছাগল। পাশের বাড়ির রাজুর আছে। আমার খেলনাগুলো বারবার কমন হয়ে যায়। সেই সময়ে বিনাকা পেস্টের প্যাকেটটা ছিল আমার কাছে প্যণ্ডোরার বাক্স। স্কুলের বন্ধুদের অনেকের বাড়িতেই বিনাকার চল ছিল। প্যাকেট খুললেই বেরিয়ে আসত একটা আধ ইঞ্চি সাইজের রবারের প্রাণী। হাতি, ঘোড়া, উট, জলহস্তী, কুমির আরও কত কি! একবার বেরোল একটা কমলা রঙের শিম্পাঞ্জি। পদ্মাসনে বসে, কোলের ওপর দুটো হাত জড়ো করে ধ্যান করছে। এটা আমার খুব প্রিয় পুতুল। মা আবার এটাকে বলত জাম্বুবান। হয়তো কোনো একটা ব্যাপারে খুব বায়না বা কান্নাকাটি করছি, মা আমাকে ভোলাবার জন্য বলল, যা তো বাবা, একবার জাম্বুবানটাকে নিয়ে আয় তো! অনেক দিন দেখিনি। ব্যাস আমিও দৌড়োলাম জাম্বুবান আনতে। পুতুলগুলো থাকত একটা ইসাবগুলের কৌটোর ভেতর।

আমার স্টিলের সুটকেসে বাবা আগের রাতে রুটিন অনুযায়ী বইখাতা গুছিয়ে রাখত। টিফিনে বেশীরভাগ সময়েই দেওয়া হতো দু' পিস মাখন পাঁউরুটি, সিঙ্গাপুরী কলা আর একটা মিষ্টি। তখন বাজারে আজকের মতন মডার্ন বা আল্ট্রামডার্ন পেনসিলবক্স আসেনি। বলতে কি প্রথম দিকে আমার কোনো পেনসিলবক্সই ছিল না। ছোটমামার বহু পুরোনো একটা টিনের জংধরা পেনসিলবক্স আমি আবিষ্কার করি। এক রবিবার ছোটমামা শিরিষ কাগজ ঘষে সেটার জং উঠিয়ে গোলাপী রং করে দিল। ব্যাস! বাক্সটা এখন আমার নিজস্ব। এতেই কত আনন্দ। আমার পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে ছিল সুকুমার রায়ের 'আবোল-তাবোল'। বিমল দাশের প্রচ্ছদ। সেটা অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম। কিন্তু ওই বইয়ের ছড়াগুলো আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। যেন এক অন্য জগতের অন্য মজা। বারবার পড়েও আশ মেটে না।

আমার মতোই স্টিলের সুটকেস নিয়ে স্কুলে আসত শঙ্কর পাল। খুব ছোটোখাটো চেহারা। সেই বয়েসেই চোখে চশমা। ওর মাথার চুলগুলো সব সময়ে খাড়া খাড়া হয়ে থাকত যেন আঁচড়ালেও বসে না। গায়ের রং ফ্যাটফ্যাটে সাদা। স্বভাবে শান্ত-শিষ্ট।

স্কুলে সুকুমার রায়ের 'গোঁফচুরি' পড়ানো হয়েছে। একদিন রেণুদি পরপর সবাইকে পড়া ধরলেন। কিন্তু ক্লাসের কেউই পুরো ছড়াটা মুখস্থ বলতে পারল না। একেকজন একটু বলেই ঢোঁক গিলছে আর রেণুদি তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে। একবার বড়দি উঁকি মেরে দেখেও গেলেন। এদিকে আমার গলাও কেমন শুকিয়ে আসছে। পারব তো! কিন্তু পুরো ছড়াটাই আমি গড়গড় করে মুখস্থ বলার পর রেণুদি খুব খুশী হয়েছিলেন। যারা কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, "দেখলি! কি সুন্দর আবৃত্তি করলো! তোরা সব একেকটা গাধা"। কিন্তু সেদিন আমি ছাড়া আরও একজন পুরো ছড়াটা মুখস্থ বলেছিল। সে শঙ্কর পাল। তারপর থেকেই শঙ্করের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়ে উঠল। জানতে পারলাম, আবোল-তাবোলের যে ছড়াগুলো স্কুলে পড়ানো হয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য অনেকগুলোই ওর একদম কণ্ঠস্থ। ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগল আর একটু একটু হিংসেও হল। এই বইটাকে সত্যিই আমি খুব ভালোবাসি। তাহলে সব কটা ছড়া মুখস্থ করলেই বা দোষ কোথায়! যা ভাবা তাই কাজ। মন দিয়ে লেগে পড়লাম। ফলে আজও আবোল-তাবোলের আশি ভাগ ছড়াই আমি হেলায় বলে যেতে পারি। একটুও আটকায় না।

সাড়ে দশটায় স্কুল ছুটির পরে বড়োমামা আসত আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে। বেরিয়ে দশ পয়সার আলুকাবলি বা পাঁচ পয়সার হজমি আমার চাই-ই চাই। জানুয়ারি এসে গেছে। বেশ ঠাণ্ডা। তাই বায়না করলেও কাঠি আইসক্রিমটা কিনে দিত না। হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম কানে ছোট রেডিও চেপে ধরে ক্রিকেট খেলার কমেন্ট্রি শুনছে অনেকে। বাবা কিছুদিন আগেই বলছিল এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতে এসেছে। সুনীল গাভাসকর আর অ্যালভিন কালীচরণের নাম তখন সবার মুখে। একদিন শঙ্কর বলল, কালীচরণ বাঁ হাতে ব্যাট করে। এক শনিবার হাফ ছুটির আগে ভূগোল ক্লাস চলছে। শঙ্কর ওর সেই স্টিলের সুটকেস খুলে পেনসিলবক্স বার করে টেবিলে রাখল। বাক্সটা দারুণ। সাদা আর সবুজ রঙের ফাটাফাটি কম্বিনেশন। ঢাকনায় স্কোয়্যার শেপের জাল। বাইরে থেকে ভেতরের সব কিছু দেখা যায়। আমরা বসেছিলাম লাস্ট বেঞ্চে পাশাপাশি। শঙ্কর চুপিচুপি বাক্স খুলে অন্তত সাত আটটা বিনাকার প্যাকেট থেকে পাওয়া রবারের পুতুল বার করে টেবিলে সাজাল।

- দেখেছিস? আরও অনেক আছে। সবগুলো আনিনি।

বললাম, "আমারও আছে অনেকগুলো। কিছুদিন আগেই একটা নীল রঙের শামুক পেলাম। তবে শামুক আমার অনেকগুলো হয়ে গেছে"।

- এক্সচেঞ্জ করে অন্য একটা কিছু নিয়ে নিবি। যার কাছে একই জিনিস দুটো আছে, তার সঙ্গে পালটে নে।

বুদ্ধিটা ভালো কিন্তু পালটাবার কথা মনে হতেই একটু থতিয়ে গেলাম। না, ওসব কিছু করব না। আমার যা আছে আমারই থাক।

শঙ্করের পুতুলগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম। এগুলোর সব কটাই আমার আছে। কিন্তু ততক্ষণে চোখ আটকে গেছে বাসন্তী রঙের ঘোড়াটার ওপর। সেটার আবার ঘাড়ের ওপর কেশর আর বেশ বড়ো ফোলা ল্যাজ। একমাত্র এই ঘোড়াটাই আমার নেই। কবে যে হাতে আসবে তাও অজানা। ঘোড়াটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখছিলাম। শঙ্কর ফিসফিস করে বলল, "এটা আমার পক্ষীরাজ। দে, বাক্সে ঢুকিয়ে রাখি। না হলে উড়ে যাবে"।

রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে ওই পক্ষীরাজ ঘোড়াটার কথাই ভাবতে থাকলাম। এরকম ঘোড়ার ছবি দেখেছি রূপকথার বইতে। শঙ্করের ঘোড়াটার দু'পাশে দুটো ডানা কল্পনা করে নিতেই সেটা যেন একদম জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল। সত্যি, এটার পিঠে চেপে যেখানে মন চাইবে সেখানেই উড়ে যাওয়া যায়। পিঠের কেশর আর ফোলা ল্যাজটাও ভীষণ সুন্দর। পরপর কয়েক রাত ঘোড়াটাকে মনে মনে কল্পনা করেই ঘুমিয়ে পড়লাম। শুধু একবার কৌতূহলবশত বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "পক্ষীরাজ ঘোড়ার ইংরেজি কি"? বাবা দিব্যি বলে দিল, "পেগাসাস"। নতুন একটা ইংরাজি শব্দ শিখলাম। বাড়িতে এলো নতুন বিনাকা পেস্ট। ভেতর থেকে বেরল একটা সবুজ রঙের বেড়াল। এটা আমার ছিল না। কিন্তু ঘোড়া কোথায়? সেটা কবেই বা পাবো? মাসে একটার বেশী টুথপেস্ট কেনা হয় না। ফলে ধৈর্য ধরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। স্কুলের কোয়ার্টারলি পরীক্ষা শেষ। ক্লাসে ফার্স্ট হলাম। বাড়িতে সকলেই খুব খুশী। প্রত্যেক বছর অ্যানুয়ালে সেকেণ্ড হতাম। বাবা বলল, "এই রেজাল্ট ধরে রাখতে হবে"। এরপর থেকেই বাবা আমার ওপর পড়ার চাপ বাড়াতে শুরু করল ক্রমশ। সে এক নাজেহাল পরিস্থিতি। মাসের পর মাস কাটে কিন্তু ওই বাসন্তী রঙের ঘোড়া আমার কপালে জুটল কোথায়? শঙ্কর মাঝেমাঝেই তার পেনসিলবক্স খুলে খেলনাগুলো বার করে টেবিলে সাজায় আর আমি জুলজুল করে তাকিয়ে থাকি ঘোড়াটার দিকে। একেই বোধহয় বলে ঘোড়ারোগ। টিফিনের ঘণ্টা বাজলে ঘর থেকে বেরোবার জন্য রোজ হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। টানা চারটে পিরিয়ডের পর একটু স্বস্তি। একটু মুক্ত বাতাস। টিফিনবাক্স হাতে নিয়েই সবুজ মাঠে ছোটাছুটি। আমার পাঁউরুটি, কলা অন্য কোনো ছেলের ধাক্কায় মাটিতে গড়াগড়িও খেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু তাতে কি! মিনিট কুড়ি একটু খেলতেই হবে।

একদিন টিফিন শেষ করার পরেই পেটটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। টের পাচ্ছি ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। না, আজ আর কোনও খেলাটেলা নয়। ঘরে গিয়ে একটু চুপ করে বসলেই হয়ত পেটব্যথা কমে যাবে। তিনতলায় উঠে ক্লাসে ঢুকে দেখলাম একদম ফাঁকা। গরম পড়ে গেছে। কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো চারটে পেল্লাই সাইজের ফ্যান ঘুরছে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করতে করতে। টেবিলের ওপর সারি সারি বন্ধুদের ব্যাগ আর সুটকেস। এখন এই ঘরটায় আমি এক মহারাজ।

সিটে বসতে যাবো, এমন সময়ে আমার চোখে পড়ল সেকেণ্ড বেঞ্চের ঠিক মাঝখানে শঙ্কর পালের স্টিলের সুটকেস। একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলাম। না, কেউ কোথাও নেই। ক্লাসরুম থেকে বেরোলেই টানা বারান্দা। সটান ঘরের দরজার কাছে চলে এলাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখি বারান্দা একদম ফাঁকা। মাঠ থেকে ছেলেদের চীৎকার, চেঁচামেচি ভেসে আসছে। খেলা চলছে জাঁকিয়ে। টিফিন শেষ হবার ঘণ্টা এখনই বাজবে। হাতে সময় নেই বললেই চলে।

আমি আর দেরি করলাম না। পায়ে পায়ে হেঁটে এসে খুলে ফেললাম শঙ্কর পালের সুটকেস। একবার ডাইনে, বাঁয়ে তাকিয়ে পেনসিলবক্স থেকে বার করে নিলাম সেই পক্ষীরাজ ঘোড়াটাকে। কিন্তু কোথায় রাখি! নিজের সুটকেসে ঢোকাতে সাহস হল না। যদি শঙ্কর ফিরে এসে দ্যাখে ঘোড়া হাপিস আর আমাকে যদি ধরে - সে এক মহা ঝামেলা। ফেঁসে তো যাবোই আর দিদিমণি অবধি জানাজানি হলে কোনো ক্ষমা নেই। বাবাকে ডেকে পাঠাবে। অনেক ভেবে টেবে ঘোড়াটাকে চালান করে দিলাম আমার পায়ের মোজার ভেতর। তখনও আমার জ্ঞান টনটনে। আমি চুরি করেছি।

টিফিন শেষ হতেই সকলের সঙ্গে শঙ্করও ফিরে এলো। সারাক্ষণ আমার এক চিন্তা। ও কিছু বুঝতে পারল না তো! পরের দুটো পিরিয়ড আমি যেন শঙ্করের দিক থেকে চোখ সরাতেই পারছিলাম না। ইতিহাস ক্লাসে শঙ্কর ওর পেনসিলবক্স খুলে পেনসিল বার করল। মিনতিদি বুদ্ধদেবের ওপর কয়েকটা প্রশ্নোত্তর লেখালেন। ছুটির ঘণ্টা পড়ল। কিন্তু কিছুই ঘটল না। ক্লাস থেকে বেরোবার আগে আমি মোজার ওপর একবার হাত বুলিয়ে দেখে নিলাম। সব ঠিক আছে। এখন ওই ঘোড়া আমার। আর আশ্চর্য, পেটের ব্যাথাটাও কোথায় উধাও হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে ঘোড়াটাকে ঢুকিয়ে রাখলাম ইসাবগুলের কৌটোর ভেতর।

এরপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম। স্কুলে যাই কিন্তু শঙ্কর আমার সঙ্গে আর আগের মতন কথা বলে না। কেমন যেন এড়িয়ে যেতে চায়। মুখোমুখি পড়ে গেলে মাথা নীচু করে চলে যায়। আগে নিজের থেকেই কত গল্প করত কিন্তু এই কয়েক দিনে সে সব চুকে গেছে। ওর মুখটা সব সময়েই কেমন যেন থমথমে। আমার মনে হতে লাগল, মুখে কিছু না বললেও ও বুঝতে পেরেছে ওই পক্ষীরাজ ঘোড়া এখন কার কাছে। বারবার ভেবেছি, কাজটা না করলেই ভালো করতাম।

পরের বছর আমি বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। খুবই প্রেস্টিজিয়াস স্কুল। বিশাল বড়ো সবুজ মাঠ যেটা প্রথমেই আমাকে আকর্ষণ করেছিল। আগের স্কুলে সেকেণ্ড হতাম বলে ঠিক অহঙ্কার নয়, একটা অন্য রকম ভালোলাগা টের পেতাম মাঝে মাঝে। এখানে আসার কয়েক মাস পরেই বুঝতে পারলাম আমার বর্তমান বন্ধুরা পড়াশোনায় আমার থেকে অনেক ভালো। আমি নেহাতই সাধারণ বা তারও নীচে। পরীক্ষায় খুবই মাঝারি মানের রেজাল্ট করতাম প্রতি বছর। কোনওরকমে টপকে যেতাম এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে। বাড়ি ফেরার পথে শঙ্করকে দেখতে পেতাম, মাথা নীচু করে আপন মনে রাস্তা হাঁটছে। ওর বয়েস যেন আমার থেকেও অনেকটা বেড়ে গেছে। সেই মাথার ওপর খাড়া খাড়া চুল। গায়ের রং আরও বেশী ফ্যাটফ্যাটে সাদা। গ্র্যাজুয়েসন কমপ্লিট করার পরেও ওকে রাস্তায় অনেকবার দেখেছি। সব সময়েই কেমন যেন মনমরা ভাব। কেমন যেন বুড়ো বুড়ো। একদিন দেখলাম ওর চশমার একদিকের ডাঁটি ভেঙে গেছে। কানের সঙ্গে সুতো দিয়ে পেঁচিয়ে কোনওভাবে আটকে রাখা। শঙ্কর কি আজও এই ঘোড়াচোরের কথা মনে রেখেছে! ছেলেবেলার অবুঝপনায় তো কতো কিছুই ঘটে। বাবা বলতো, চুরি করা মহাপাপ। কিন্তু সেই বয়েসে যা করেছিলাম তাতে কি আমার অ্যাকাউন্টে পাপ বলে কিছু জমা হয়েছিল? ওই ইসাবগুলের কৌটো খুলে উঁকিও মেরেছি কয়েকবার। পুতুলগুলো একটু বিবর্ণ। সব কটাই আছে এমনকি ঘোড়াটাও।

আমার পুরোনো স্কুলের একদম গায়েই শঙ্করের বাড়ি। কয়েক বছর আগে ওখানে একটা ছোট ক্লাব গজিয়েছে। ক্লাবঘরের ভেতর খুব কম বয়েসি ছেলেরা দাবা খেলে। এটা আমার চোখে পড়েছিল। একদিন ঢুকলাম ক্লাবের ভেতর। মন দিয়ে দাবা খেলা দেখছিলাম। পাশের একটা বোর্ড ফাঁকা হতেই একটি ছেলে আমাকে ডাকল, "আঙ্কেল আপনি খেলবেন"? আমরা ছেলেবেলায় বাবার মতো কোনো মানুষকে কাকু বা মেসোমশাই বলে সম্বোধন করতাম। সময় পাল্টেছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। সম্মানটাই বড়ো কথা। খেলব বলে বসতে যাচ্ছি হঠাৎ ক্লাবঘরের দরজার কাছে দাঁড়ানো দু' তিনটে ছেলে চিৎকার করে কাকে যেন ডাকতে শুরু করলো।

- দাদু, ও দাদু। খেলবে না? ভেতরে এসো।

ভাবলাম গলি দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। তাকেই ডাকছে। নিশ্চয়ই রোজ দাবা খেলে। আমার অনুমান সঠিক। কিন্তু ঘরের ভেতর যে মানুষটি ঢুকল সে আর কেউ নয়, শঙ্কর পাল। কি আশ্চর্য! অনেক দিন পর বাহান্ন বছরের চোখ দিয়ে দেখলাম শঙ্করের বয়েস যেন প্রায় সত্তর। মাথার খাড়া চুল সব সাদা। ধোপদুরস্ত ধুতি আর পাঞ্জাবিতে মানিয়েছে দারুণ। চোখে সোনালি চশমা। ডান হাতে ছাতার বাঁটের মতো লাঠি। হাঁটছে সামান্য ঝুঁকে। ছেলেগুলো শঙ্করকে আমার সঙ্গেই খেলতে বসালো। একবারের জন্যেও মনে হল না ও আমাকে চিনতে পেরেছে। মাঝে কেটে গেছে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর অথচ আজও আমার সব কিছুই মনে আছে। একটু খেলতেই বুঝলাম ছেলেগুলোর দাদু অত্যন্ত কাঁচা প্লেয়ার। অনেকেই ভিড় করে আমাদের খেলা দেখছিল। হঠাৎ আমি একটা সুযোগ পেতেই গজ দিয়ে শঙ্করের একটা ঘোড়া মেরে দিলাম। এবার খেলা আমার হাতের মুঠোয়। অবধারিত জয়।

ঘোড়াটাকে মেরে বোর্ড থেকে নামিয়ে টেবিলের ওপর রাখছি হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে শঙ্কর হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাঁদছে তো কাঁদছেই। ক্রমশ সেটা চলে গেলো ফোঁপানির পর্যায়ে। কিছুক্ষণ পর চশমা খুলে রুমালে চোখ মুছলো শঙ্কর। তারপর খেলা অসমাপ্ত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লাঠি ঠুকতে ঠুকতে। আমি হতবাক।

- তোমাদের দাদুর মাথায় কোনো গণ্ডগোল আছে না কি?

ছেলেগুলো হাসতে হাসতে বললো, "কে জানে। দাদু ওরকমই। মাঝেমাঝে এমন সব আচরণ করে, অবাক হয়ে যাবেন। একদিন দেখি হাতের লাঠির বাঁকানো দিকটা এক ঠেলাওয়ালার গেঞ্জির ভেতর ঢুকিয়ে টানছে। তারপর শুরু হলো বকাবকি। ঠেলার চাকার কাদা কেন দাদুর ধুতিতে লেগেছে!লোকটা পালাতে চাইছে আর দাদু লাঠি দিয়ে গেঞ্জিটা কষে আটকে রেখেছে। আমরা কোনওমতে সামাল দিলাম। ঠিক আছে আঙ্কেল। আরেক দিন দাদুর সঙ্গে আপনাকে বসিয়ে দেবো"।

হাসি পেল। আমি আঙ্কেল আর শঙ্কর দাদু। দুনিয়ায় কতো কি ঘটে।

এরপর সেই বিভীষিকাময় পর্ব। করোনা ভাইরাসের উৎপাত। সারা পৃথিবীজুড়ে হাহাকার। লকডাউনের আগে বেশ কিছু পরিমাণ চাল, চিনি, ছাতু, আটা আর চা বাড়িতে মজুত করলাম। কিনে আনলাম একটা বড়ো ঘি-এর শিশি। রাস্তাঘাট সব শুনশান। ঠিকমতো মোবাইল রিচার্জ করতেও পারছি না। আত্মীয়, বন্ধু সকলের সঙ্গেই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মাঝেমাঝে একটা দুটো মৃত্যুর খবর কানে আসে। মন খারাপ হয়। বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সময় কাটাই পি. জি. হসপিটালের ভেতর। বাইরে নানান সংস্থা থেকে খাবারের গাড়ি এসে দাঁড়ায়। এতো রকম বিনামূল্যের খাবারে আমার কাঁধের ব্যাগ ভরে ওঠে। পাঞ্জাবিরা গুরুদ্বার থেকে প্রতি রাতে ভাত, ডাল আর সব্জির প্যাকেট বিতরণ করে। নম্রমুনীর সেবকরা রুটি, সবজির গাড়ি লাগায় ফুটপাতের পাশে। খাবার নেওয়াটা কেমন যেন নেশার মতো হয়ে যায়। এতো খাবার যে একজনের পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়। ফুটপাতের গরীব মানুষদের অনেক কিছুই বিলিয়ে দিই ফেরার সময়ে।

এক রাতে দেখলাম ওই ক্লাবের ছেলেগুলোও বেরিয়েছে ব্যাগে বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, "আঙ্কেল আপনার প্যাকেট লাগবে? নিন না। অনেকগুলো আছে"। বললাম, "আমার ব্যাগে অনেক খাবার। তোমরা বরং এর থেকে কিছু নাও"। যা ছিলো প্রায় ব্যাগ শূন্য করে ওদের দিয়ে দিলাম। আর তারপরেই ঘটনাটা শুনলাম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দিন তিনেক আগে মারা গেছে শঙ্কর পাল। ওদের সেই দাদু। রাতে স্বপ্ন দেখলাম। বিশাল বড়ো এক বাসন্তী রঙের পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে বসে আছে শঙ্কর। আমাকে দেখে হাসতে হাসতে হাত নাড়লো। বললো, "চলি বন্ধু। আবার কখনও দেখা হবে"। শঙ্করকে পিঠে বসিয়ে উড়ে গেল পক্ষীরাজ। মনখারাপের রেশ পরদিন বেলা অবধি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

দুপুরের দিকে কাঁচের বাটিতে ছাতু নিয়ে মাখছি হঠাৎ আমার হাত থেকে বাটিটা পড়ে গেল। একদম ফেটে চৌচির। ঝাঁটা দিয়ে মেঝে পরিস্কার করার সময়ে মনে পড়ল, একটা ভাঙা শোকেসের ভেতর বেশ কয়েকটা কাঁচের বাটি রেখেছিলাম কাগজ জড়িয়ে। সে প্রায় অনেক বছর আগের কথা। শোকেসটা খোলা হয়নি বহু দিন। ভাঙা শোকেস খুলে কাগজ মোড়া বাটিগুলো বার করতে গিয়ে হঠাৎ আমার হাতে ঠেকল সেই ইসাবগুলের কৌটো। ওটার কথা আর মনেই ছিল না। কে, কখন এখানে গুঁজে রেখেছে তাই বা কে জানে!কৌটো খুলে হাতের তালুর ওপর ঢেলে দিলাম খেলনাগুলো। আমার ছেলেবেলার মোহর। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দেখলাম সেগুলোর ওপর একটা কালচে ছাপ পড়েছে। বেশ কয়েকটা নেই। কিভাবে হারালো তাও জানি না। আর কি আশ্চর্য! সেই বাসন্তী রঙের পক্ষীরাজটাকেও পেলাম না। শঙ্কর কি তাহলে সত্যিই ওর ঘোড়াটাকে নিয়ে চলে গেল!

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।