বিবিধ

বিশ্বকাপ ফাইনাল, ১৯৮৭, ইডেন উদ্যান



দেবাশিস সেনগুপ্ত


ফাইনালিস্ট একটি দলের অধিনায়ক খেলার আগের দিন খুব ভেঙ্গে পড়লেন আম্পায়ারদের নাম জেনে। কারণটা শুনলে এখনকার ফলাফলসর্বস্ব অশালীন সৌজন্যহীনতায় ভুগতে থাকা ক্রিকেটীয় পরিবেশ চমকে উঠবে। ফাইনালিস্ট একটি দলের সেই অধিনায়ক ভেঙ্গে পড়েছিলেন ফাইনালের আম্পায়ার লিস্টে এমন একজনের নাম না দেখে, যিনি ছিলেন তার ফাইনালের প্রতিপক্ষ দেশের নাগরিক। এইসব রূপকথা আটের দশক, এমনকি ন'য়ের দশকেরও পরিচয়পত্র ছিল।

ইংল্যান্ডের অধিবাসী সেই আম্পায়ারের 'গল্প হলেও সত্যি' শোনাব এই সংখ্যায়। তাঁর প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বর্ডারের শ্রদ্ধা সেদিন মনখারাপে ভেঙ্গে পড়ায় পর্যবসিত হয়েছিল এবং তাঁকে আম্পায়ারিং প্যানেলে রাখার জন্য সরকারী আবেদন করেছিলেন অ্যালান বর্ডার। ১৯৭৫, ১৯৭৯ আর ১৯৮৩ - পরপর তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালেই একজন আম্পায়ার 'কমন' ছিলেন, যিনি আমাদের আজকের লেখার নায়ক। তারপরে 'নিউট্রাল আম্পায়ার' কনসেপ্ট আনে আইসিসি। এবং মুম্বাইয়ে ভারতকে সেমিফাইনালে (সুনীল গাভাসকারের কেরিয়ারের শেষ ওডিআই ম্যাচ এবং সামগ্রিকভাবেও বিদায়ী ম্যাচ) হারিয়ে ১৯৮৭-র বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড। তাই এই ফাইনালে আম্পায়ারিং প্যানেল থেকে বাদ পড়েন ইংল্যান্ডের ডিকি বার্ড। তার 'বিহনে' অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বর্ডারের সশ্রদ্ধ মনখারাপ দিয়েই শুরু করেছি এই লেখা।

১৯শে এপ্রিল, ১৯৩৩ তারিখে সেই আম্পায়ারের জন্ম হয়েছিল ইয়র্কশায়ারের বার্ণসলেতে। ১৯৭৩-এর ৫ই জুলাই হেডিংলেতে ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং কেরিয়ার, ৪০ বছর বয়সে। তাঁর বাবা ছিলেন খনিতে কর্মরত। ১১তে পড়া ছাড়া, খনিতে কাজ নেওয়া, সেটা ছেড়ে দেওয়া, ক্রিকেটকে পেশা করা, ডানহাতি ব্যাটিং আর ডানহাতি অফব্রেক পুঁজি করে ১৯৫৬-১৯৫৯ ইয়র্কশায়ারে আর ১৯৫৯-১৯৬৪ লেস্টারশায়ারের হয়ে খেলা। কিন্তু ৯৩ ম্যাচে ২টি শতরান, ১৪টি অর্ধশতরান আর ২০.৭১ গড় এবং হাঁটুর আঘাত তাঁর খেলোয়াড় জীবনে পর্দা টেনে দেয় সময়ের অনেক আগেই, ৩১ বছর বয়সে।

তারপরেই তাঁর আম্পায়ারিংয়ে আসার সিদ্ধান্ত। ৬ বছরের 'সাধনা' শেষে কাউন্টি ম্যাচে আম্পায়ারিং শুরু ১৯৭০ সালে। আর তারও ৩ বছর পরে ১৯৭৩-এর ৫ই জুলাই হেডিংলেতে শুরু আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং কেরিয়ার। তারপর ১৯৯৬-র ভারত বনাম ইংল্যান্ড, লর্ডস টেস্ট পর্যন্ত ৬৬টি টেস্ট আর ৬৯টি একদিনের ম্যাচে আম্পায়ারিং করা। ১৯৯৬-র ভারত বনাম ইংল্যান্ড, লর্ডস টেস্টই ছিল আম্পায়ার হিসেবে তাঁর শেষতম টেস্ট, যে টেস্টে সশব্দ অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলী আর রাহুল দ্রাবিড়ের। মাইক গ্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে শেন ওয়ার্নের 'শতাব্দীর সেরা বল'-এর ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টেও অন্যতম আম্পায়ার ছিলেন তিনিই।

তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির আম্পায়ারদের 'ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর', যারা নিরপেক্ষ আম্পায়ারিং করাটাকে শৈল্পিক পোশাকে ঢেকে দিতেন। নিজের দেশকে টেনে খেলাতেন না, বিপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে গিয়েও আম্পায়ারিং করতেন না। তাই সব দেশের প্রায় সব খেলোয়াড়দের আস্থাভাজন প্রিয় আম্পায়ারের নাম ছিল ডিকি বার্ড। এবং আম্পায়ারিং করার ফাঁকে ফাঁকে ও আম্পায়ারিং করতে করতে তাঁর কিছু কাজ থেকে গেছে ইতিহাসে, তাঁকে করে দিয়েছে প্রবাদপ্রতিম। তিনি সেই প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেট আম্পায়ার, যাঁকে ক্রিকেট সমাজ চিনত ডিকি বার্ড নামে।

ডিকি বার্ডের কথা অমৃতসমান। শেষ হতেই চায়না। ইয়র্কশায়ারের বার্ণসলেতে তাঁর একটি মূর্তি গড়া হয়েছে, এটাও ইতিহাস। প্রখর অনুমান ক্ষমতা, অনবদ্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ক্রিকেটীয় ধ্যানধারণার স্বচ্ছতা এবং নিজের কাজে নির্মোহ নিরপেক্ষতা, ডিকি বার্ডকে পরিণত করেছে এক চিরস্মরণীয় আন্তর্জাতিক আম্পায়ারে। যাঁর কাজের ব্যাপ্তি ছিল ২৩ বছরের একটা লম্বা সময়, ভারতীয় দৃষ্টিকোণে যা সানি-ভিশি থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল সৌরভ-রাহুলে, মাঝে দিলীপ-আজহার-শচীন ছুঁয়ে।অথবা বেদী-চন্দ্র থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল শ্রীনাথ-প্রসাদে, মাঝে কপিল-চেতন-মহিন্দার ছুঁয়ে।

ভালো থাকবেন আপনি, ডিকি বার্ড। আপনি না থাকলে অনেকটাই ফিকে হয়ে যেত আমার ওই ২৩ বছরের রঙীন জাদুময় ক্রিকেট দিনকাল। আপনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আপন মর্যাদায় তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আপনাকে বিদগ্ধ ক্রিকেটপ্রেমীদের পক্ষ থেকে শতকোটি প্রণাম।