[একজন সৃষ্টিশীল মানুষ একদিন স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। প্রাত্যহিক জীবনের দ্বিধা দ্বন্দ্বে জীর্ণ জীবনকে এক নতুন রসের ধারায় নিজেকে সিক্ত করতে তার এই স্বেচ্ছানির্বাসন নাকি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে তা তিনি নিজেও জানেন না। অথচ তার এই নির্বাসনকালে তার জীবন ও লেখা বাঁক নেয় এক নতুন পথে। নিজের সৃষ্টিকে নতুন করে তিনি কি গ্রহণ করতে পারবেন নাকি বিসর্জন দেবেন অবসাদের গভীর অন্ধকারে? এই টানাপোড়েন নিয়েই লেখা অভিজিৎ রায়ের এই নতুন উপন্যাস "নিখোঁজ কবির ডায়েরি"।]
(এক)
কেয়ারটেকারকে খাবারের জন্য বাজার করতে দু'শ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে নিজের শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিল সৃজিত। জায়গাটা সত্যিই অসাধারণ। এক্কেবারে নিস্তব্ধ। ঠিক যেমনটা চেয়েছিল সৃজিত। জানলা দিয়ে দূরে কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ঘরে ঢোকার সময় খেয়াল করেছে ব্যালকনি থেকেই জয়ন্তী নদীর উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাদা নুড়ি-পাথরগুলো দেখা যায়। শ্যামলাল বলছিল, "জল আর একদমই নেই বাবু। বর্ষায় পাহাড়ে বৃষ্টি হলে তখন তাও..." সৃজিত একঝলক শুকনো, ঝকঝকে নুড়িপাথরগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে হাতের ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। কেয়ারটেকার শ্যামলাল টেবিলের উপর জলের বোতল, গ্লাস, অ্যাসট্রে গুছিয়ে দিয়ে বলল, "আমি তাহলে বাবু বাজার থেকে আসি?" হাতের ইশারায় শ্যামলালকে বাজারে যাবার পারমিশন দিয়ে বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিল সৃজিত।
গতকাল দুপুরে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। ওইসময় ঘরে কেউ থাকে না। বৌ অঞ্জনা কর্মক্ষেত্রে আর মেয়ে সোহিনী কলেজে। প্রথমে ভেবেছিল খাবার টেবিলের উপর একটা কাগজে দু-এক কলম লিখে আসবে। আসেনি। ইচ্ছে করেনি। আসলে সৃজিত এখনও বুঝতেই পারছে না সে এরকম কেন করল? বাড়ি ছেড়ে এভাবে সে কত দিন বাইরে থাকতে পারবে তাও জানে না। আসলে এই নিজেকে না জানা আর না বোঝার মধ্যেই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল সৃজিত। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে প্রথমে সিম কার্ড চেঞ্জ করল সে তারপর সুইচড্ অন করল। চাটার্ড একাউন্টট্যান্ট বিনয় গুহকে একটা ফোন করল।
- গুডমর্নিং বিনয়বাবু। সৃজিত বলছি।
- গুডমর্নিং স্যার। সব ঠিকঠাক আছে তো?
- হ্যাঁ। একদম ঠিকঠাকভাবে এখানে পৌঁছেছি। আপনাকে যা বলেছি সেটা মনে রাখবেন। কোনো অবস্থাতেই কারোর কাছে আমার এই অজ্ঞাতবাসের খবর বা ঠিকানা জানাবেন না। আমার বাড়ির লোকের কাছেও না।
- একদম সৃজিতবাবু। কিন্তু মনে থাকে যেন। ফেরার পরে পাণ্ডুলিপিটা যেন আমিই প্রথম পড়ার সুযোগ পাই।
- নিশ্চয়ই। এই নম্বর আপনার কাছে ছাড়া আর কাউকেই দিইনি আমি। প্রয়োজনে ফোন করব। আপনিও করতে পারেন। আজ একটু ঘুরেফিরে ফ্রি হয়ে নিই। আগামীকাল থেকে লেখা শুরু করব।
- আচ্ছা স্যার। ভালো থাকবেন। যে কোনো প্রয়োজনে শ্যামলাল আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। শহরে আসার জন্য গাড়ির দরকার হলে ওকেই বলবেন। ভাল থাকবেন।
- রাখি তাহলে?
- হ্যাঁ। রাখুন।
ফোনটা কেটে দেবার পর সৃজিত মোবাইল সুইচড্ অফ করে দেয়। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে। বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে নিয়ে একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। হালকা শীত। বেশ উপভোগ্য। এক কাপ চা বা কফি পেলে জমে যেত। শ্যামলাল না ফেরা পর্যন্ত উপায় নেই। সৃজিত সিগারেট ধরায়। অঞ্জনা আর সোহিনীর কথা মনে আসে। এত বেশি দুর্ভাবনায় ওদের ফেলে আসাটা কি ঠিক হল? সৃজিতের মনে হয় ঠিক, ভুল সবই আপেক্ষিক। এখনকার ঠিক ভবিষ্যতে ভুল মনে হবে অথবা উল্টোটা। ওদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে তাকে। নিজের মধ্যেকার শয়তান এবং ভগবান দুটোকেই চিনতে হবে তাকে। লিখে যেতে হবে। স্বীকারোক্তি! হয়ত তাই অথবা নয়। হয়তো একটা উপন্যাস কিন্তু তারই পরতে পরতে জীবনের অমোঘ স্বীকারোক্তি! আঙ্গিক পরিষ্কার নয়।
কিছুদিন আগেই কবি অরুময় গোস্বামীর বাড়ি গিয়েছিল সৃজিত। লেখা প্রসঙ্গে সৃজিতকে উনি বললেন, "রুশোর 'কনফেশন' পড়েছ? টলস্টয়ের 'কনফেশন'? টলস্টয়ের একটা নাটক আছে জানো তো! 'পাওয়ার অফ ডার্কনেস'! পড়েছ? এগুলো পড়ে নাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এগুলো সব সময়োত্তীর্ণ রচনা। যে কোনও লেখককেই অন্ধকার সময়ে আলো দেখাতে পারে। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের যেমন ব্যাড প্যাচ থাকে তেমনই লেখকদের। এই সময়গুলোতে স্বীকারোক্তি একটা খুব ভাল উপায়। নিজেকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে নিয়ে যাবার পথ সুগম করে। তুমি তো ইদানিং গদ্য লিখছ। পড়ে নিও। দেখবে খুব উপকার লাগবে।"
মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে অরুময়দার মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনছিল সৃজিত। ভদ্রলোক কথা শেষ করে নিজের বেডরুমের ভিতরে গিয়ে টলস্টয়ের বইটা হাতে করে নিয়ে এনে দেখালেন। "আজকাল অ্যামাজনেও কিনতে পাওয়া যায়। নিয়ে নিও। কাজে লাগবে। যত বয়স বাড়বে তত কাজে লাগবে।" সৃজিতের হাসি পেয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে। অরুময়দার বেশ কিছু উপন্যাসে স্বীকারোক্তির ধরণটা ধরা পড়ে গেল পাঠক সৃজিতের কাছে। কিন্তু অসম্ভব একটা সম্মানবোধ তৈরি হচ্ছিল অরুময়দাকে নিয়ে। কলকাতার বেশিরভাগ অগ্রজ লেখক, কবিরাই কিন্তু এই পথ দেখানোর কাজটা মন দিয়ে করেন না।
সৃজিত কি সত্যিই এখানে লেখার জন্য এসেছে? আচ্ছা, জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে কি জীবন নিয়ে কিছু লেখা সম্ভব? আঙুলের ফাঁকের চামড়ার জ্বলনে সে বুঝতে পারে তার সিগারেটের জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। সিগারেটটাকে সামনের বাগানের দিকে ছুঁড়ে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ে সৃজিত। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পরক্ষণেই তার মনে হয়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী হবে? মনের খুঁতগুলো কি আয়না ঠিকমতো দেখিয়ে দিতে পারবে?
- তুমি ক্রমশ কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছ সৃজিত। নিজের অপদার্থতাকে এভাবে লোকের ঘাড়ে ফেলে দিতে তোমার লজ্জা করে না? লিখে কী হয়? সংসার চলে? যখনকার দিনে চলত তখনকার কথা বাদ দাও। তুমি যদি মাসে কুড়িটা গল্পও লিখতেও পারো কে তোমাকে কুড়িটা গল্প লেখার জন্য অন্তত কুড়ি হাজার টাকা দেবে?
- ছাপা হলে দেবে।
- আবার মিথ্যে কথা! ক'টা পত্রিকা আজকাল লেখার জন্য টাকা দেয় সৃজিত? তোমাকে কতবার বলেছি। ভাল করে তাকিয়ে দেখ। যাঁরা নামধাম করেছেন বা বাণিজ্যিক কাগজে লিখছেন বা প্রকাশকদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছেন তাঁদের বেশিরভাগই আমলা। মাইনের টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বই করে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরেছে। এখন আর সে দিনকাল নেই। অন্য কিছু ভাবো।
ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। না, ভুল ভাবছে সৃজিত। ভাবনাগুলো এলোমেলোই হয়ে থাকে। কবিতা লেখার সময় ঠিক বোঝা যায় না। অবচেতনের বিমূর্ত ভাবনাগুলো নিজের অজান্তেই যখন সার বেঁধে দাঁড়ায় তখন চিত্রকল্প সুন্দর হয়ে ওঠে আর পাঠযোগ্যতা সম্পূর্ণ ভাবনাকে কবিতা করে তোলে। কিন্তু, গদ্যের ক্ষেত্রে তো সেরকম হবার সুযোগ কম। পাঠক তো গল্প খুঁজবে। গল্পের ভিতর গল্প। যে গল্প তার জীবনের সঙ্গে মিলে যাবে অক্ষরে অক্ষরে। অভাব, অভিযোগ মিলে যাবে। প্রেম, অপ্রেম মিলে যাবে। মিলে যাবে প্রাত্যহিক চিৎকার এবং শীৎকারও। যদিও কবির জীবন একটু আলাদা। তাতে কী? কবি কি আলাদা কিছু লিখবে? কবির চারপাশে যারা আছে তারা তো আলাদা কিছু নয়। কাজেই সেইসব চরিত্র দিয়ে পাঠককে কি সে খুশি করাতে পারবে না? অঞ্জনার মুখটা আয়নায় এক ঝলকের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। চমকে উঠল সৃজিত। পরক্ষণেই নেই।
"সাহাব খাবার তৈরি!" শ্যামলাল দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলে।
- নিয়ে এসো। বারান্দায় বসেই খাব। আচ্ছা শ্যামলাল, তোমাদের এখানে খবরের কাগজ আসে না!
- আসে সাহাব, তবে বেলা হয়ে যায়। আপনার জন্য নিয়ে আসব বাজার থেকে?
- নাহ। দরকার নেই। খাবার নিয়ে এসো।
বারান্দায় রাখা চেয়ারের সামনে ছোট টেবিলটা এগিয়ে এনে রাখে শ্যামলাল। তারপর খুবই দ্রুত থালা ভর্তি করে লুচি আর সাদা আলুর তরকারি নিয়ে এসে রাখে। সৃজিতের খুব আনন্দ হয়। তারপরই ভয়। মনে হল অঞ্জনা পাশ থেকে বলছে, "খাও খাও। সুগারটা মেপেছ কত হল? সুগারে মানুষ মরে না জানো তো? বিছানায় পড়ে থেকে জ্বালায়। বুড়ো বয়সে আর কত জ্বালাবে?"
- শ্যামলাল, কাল থেকে রুটি। লুচি নয়। আর আলু বাদে যে কোনো তরকারি। বুঝলে?
- জী সাহাব। আগে জানলে আজকেই করে দিতাম। চা আনি? চিনি ছাড়া তো?
- হ্যাঁ। চিনি ছাড়া। তবে দুধ চা।
হোম স্টে-টার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি কুকুর উঠে এসেছে। গায়ের রং এক্কেবারে ধবধবে সাদা। সৃজিত একটা লুচি ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরো করে কুকুরটার সামনে এগিয়ে দেয়। শ্যামলাল চা রাখে টেবিলের উপর।
- এটা কার কুকুর শ্যামলাল?
- আমাদের সাহাব। কুকুর কি আপনার পসন্দ নয় সাহাব?
সৃজিত হাসল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, তার কী কুকুর পছন্দ? উত্তর পেল না। অপছন্দ? নাহ, তারও কোনো সঠিক উত্তর নেই। সৃজিতের মনে হল, এই জন্য তার সংসারে এত সমস্যা, ঝামেলা। তার কাছে কোনও কিছুরই উত্তর জানা নেই। এমনকি তার নিজের পছন্দ, অপছন্দেরও। অঞ্জনাকে কি সে পছন্দ করে? ভালবাসে?
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।