গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (সপ্তদশ পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট চলাকালীন একদিন জানতে পারলাম আমার মা খুব একটা ভালো নেই। তিনি কৃষ্ণনগর ছেড়ে পুনরায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। এখানে কেউ তাঁকে সারাজীবন ধরে নিজের কাছে রাখতে চায়নি। তাই তীব্র মনোকষ্ট নিয়ে তিনি চলে গেছেন। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে যে, আমি তাঁর ছেলে হয়েও তাঁর জন্য কিছু করতে পারছি না। কেননা আমি যে সামান্য কটা টাকা টিউশনি করে পাই তাতে আমাকেই খুব কষ্ট করে চলতে হয়। এখন কলকাতা যাতায়াত করে পড়াশোনা করতে হয় বলে টিউশনিও কমিয়ে দিতে হয়েছে। তাই আমার উপার্জন অনেকটা কমে গেছে। তবুও মা যদি একটিবার আমাকে এসে বলতেন আমি অন্তত চেষ্টা করে দেখতাম। ভালো কিছু না হলেও দুটো ডালভাত ঠিক জুটে যেতো। কিন্তু তিনি আমার কাছে আসেননি তাঁর অদম্য জেদের কারণে, মুখ দিয়ে একবার আমাকে অস্বীকার করে ফেলেছেন, আবার আমার কাছে তিনি এলে তাঁর আত্মসম্মান হারাবেন এ-ই আশঙ্কা হয়তো তাঁকে আমার কাছে আসতে বাদ সেধেছে। তাছাড়া বাবা চলে যাবার পূর্ব মুহূর্তে বলে গেছেন - দেখ যে ছেলেটাকে তুমি সারাজীবন ধরে অবজ্ঞা করেছ, অবহেলা করেছ, নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছ, শেষ বয়সে সে ছাড়া আর কেউ তোমাকে দেখবে না, আমি তাকে এমনই শিক্ষা দিয়েছি যে সে তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তা রক্ষা করবে। আর আজ তুমি যাদের জন্য চোখের জল ফেলছ তারা তোমার জন্য বিন্দুমাত্র ভাববে না ওরা কেবল দূর থেকেই হায় হায় করবে। আমি মনশ্চক্ষে সবকিছু দেখতে পাই।

আমার মা তো প্রচণ্ড জেদি এবং রাগী, সুতরাং তাঁর ভাবনাটা এমনই যে, না খেয়ে মরে গেলেও তিনি তাঁর মত থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবেন না। সে যাইহোক তিনি তো আমার মা, আমি কোনোভাবেই তাঁকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করতে পারি না। আজ হয়তো আমি পারছি না, কিন্তু আমারও সুদিন আসবে সেদিন আমাকে কিছু একটা তো করতেই হবে, সবাই উপেক্ষা করলে তাঁর মনের ভেতর জমে থাকা শব্দহীন অনুভূতিগুলোকে সাকার দেবে কে? আমার মনোলোকেও নানা প্রশ্নের ডালি, সবকিছুর উত্তর আমার জানা নেই। উত্তরগুলোকে খুঁজতে হবে। কপর্দকহীন অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেছে। যেভাবে এগোতে চেয়েছি হয়তো পুরোপুরি মসৃণ ভাবে সবকিছু হয়নি তবু একা একা পথ চলতে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তার মূল্যই বা অস্বীকার করি কীভাবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। আমার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে স্নাতকস্তরে অনেক বন্ধুকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। বিদ্যালয় জীবনের কথা খুব সহজে ভোলা যায় না। এক অতিদীর্ঘ সময় ধরে চলে এই জীবন, এখানে তৈরী হয় এক অপূর্ব ভালোবাসার টান, অকৃত্রিম সম্পর্ক। কতকগুলি নিষ্পাপ, সহজ সরল স্বভাবের, স্নিগ্ধ হাসির পুষ্পবৃষ্টি, সবাই সেই সুশীতল ধারাবর্ষণে স্নাত হই। ফুলের মতো কোমলমতি শিশু কিশোরদের মায়াময় হাসি আর আনন্দের সমাহারে সজ্জিত জীবন। শিক্ষক শিক্ষিকাদের নৈকট্য, তাদের স্নেহস্নিগ্ধ শাসন আর অকৃত্রিম অপত্য স্নেহ জীবনকে করে তোলে মধুময়। পার্থিব জীবনের স্বর্গ হলো বিদ্যালয় জীবন। জীবন পথের এই ধারা প্রবাহ ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে যত সিঁড়ির পরবর্তী ধাপগুলোতে এগোনো যায়। অনেকটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মতো। আমরা যতই উপরের দিকে উঠতে থাকি আমাদের জীবনীশক্তি কমতে শুরু করে, তেমনই বিদ্যালয় জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ক্রমশ অন্তরঙ্গ বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে তখন যেন সম্পর্কটা অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে যায়, সময়ের সাথে গতিবেগের তারতম্য অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই কেবলই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। পাটিগণিতের নিয়ম অপেক্ষা বড়ো হয়ে দেখা দেয় চার্লস ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব - যোগ্যতমের উদ্বর্তন। তাই একশো বিশ থেকে নেমে আসে মাত্র চারে, তার মধ্যে দুজন সাধারণ আর দুজন অসাধারণ। এই চারের মধ্যে আবার স্কুল জীবন থেকে আসা মাত্র একজন। সংখ্যা যা-ই হোক না কেন এই চারের সম্পর্কে সহজে চিড় ধরে না - এটাই জীবনের অলিখিত নিয়ম। অবশ্য যদি সমলিঙ্গ হয় তাহলে সত্যতা বজায় থাকে, বিপরীত লিঙ্গের হলে তার ব্যতিক্রম হতে পারে। কোথায় কোন প্রদেশে কার জন্য চাল ডাল মাপা থাকে তা বলা দুষ্কর।

স্নাতকোত্তর পাশ করার পর আমাদের সম্পর্ক বজায় থাকলেও সবার সাথে একরকম ছিলো না। কেবলমাত্র সমীরণের সাথেই যোগাযোগটা বেশি ছিলো। সমীরণ মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসতো। সমীরণ একদিন জানালো - বুঝলি জয়, অনেকদিন ধরে তোকে একটা কথা বলবো বলে ভাবছি। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না। তুই অভয় দিলে বলতে পারি।

আমি বললাম - তুই কী বলতে চাইছিস তা আমি জানি। তা অত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে? ঝট করে বলেই ফেল না বাবা, মেয়েটি কে?

- আসলে আমি জানতাম তুই সবকিছুই জানিস। কিন্তু ভয়টা কোথায় জানিস?

- হ্যাঁ, বল। কীসের এত ভয়? ভালোবাসার মধ্যে আমি তো কোনো অন্যায় দেখি না। তাছাড়া তুই তো আর কচি খোকাটি নোস যে প্রেমে পড়তে বাঁধা থাকবে।

- সেটা আমিও জানি। কিন্তু...

- আবার কিন্তু। এই, কী হয়েছে পরিষ্কার করে বল তো।

- আসলে মেয়েটি মুসলিম তো তাই।

- হ্যাঁ। তা কী হয়েছে? মুসলিম হোক বা খ্রিষ্টান হোক সে একটা সুস্থ মানুষ তো? মানে সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন তো, না গোঁড়া মুসলিম?

- সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন তো বটেই। লেখাপড়া জানা মেয়ে, কলেজে অধ্যাপনা করে।

- কে? আমাদের আশিয়া নয় তো?

সমীরণ কোনো কথা না বলে মাথা নীচু করে সাড়া দেয়।

- কতদূর এগিয়েছে?

- অনেকটা। কিন্তু আমার বাড়ির কেউ রাজি হচ্ছে না। আশিয়াদের বাড়িতে কোনো সমস্যা নেই। আশিয়া বলেছে খিদিরপুরে ওদের একটা বাড়ি ফাঁকা পড়ে রয়েছে ওর বাবাকে বলে ওটা ওর নামে করে নিয়েছে। ওখানেই থাকতে চাইছে। আমার কলেজটাও ওখান থেকে কাছেই হবে। আশিয়ারও সুবিধা হবে।

- তবে আর ভাবনা কী? পরিকল্পনা অনুযায়ী লেগে যাও, সঙ্গে আছি।

- আশ্বস্ত হলাম।

(ক্রমশ)