গল্প ও অণুগল্প

কাজল চোখ



অচিন্ত্য সাহা


অনেকটা সময় কেটে গেল এখনও পর্যন্ত সাগর এসে পৌঁছয়নি। স্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিতানের পা দুটো টনটন করে। না, আর অপেক্ষা করা চলে না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে ন'টা বাজে। এর পরের ট্রেন ধরতে গেলে কলেজে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। আজকের ফার্স্ট পিরিয়ড অ্যাটেন্ড করাটা খুব জরুরী। সপ্তাহে একটা মাত্র পিরিয়ডে ছন্দ অলংকার পড়ান ম্যাম। সুদূর সাউথ ক্যালকাটা থেকে ভোর চারটের বাসে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে সাতটা পঁয়ত্রিশের কৃষ্ণনগর লোকাল ধরেন। এই ট্রেনের তিন নম্বর কামরায় জানালার পাশে সিট নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে অবগাহন করে শরীর ও মনের খোরাক জুগিয়ে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছে বুড়োর চায়ের দোকান থেকে দু'কাপ গরম গরম চা এবং ডিম টোস্ট গলাধঃকরণ করে কলেজে পৌঁছন। বিতান সামনের বেঞ্চে বসে ম্যামের শিক্ষাদান পদ্ধতি, চলাফেরা, কথা বলার ধরন, সর্বোপরি ছন্দ অলংকারের সৌন্দর্য উপভোগ করে। মাঝে মাঝে ম্যাম তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা বলে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করেন। বিতান একটু আবেগপ্রবণ এবং সৃজনশীল। ম্যামের কথা মন দিয়ে শোনে, ওর চোখে জল এসে যায়। মনে মনে কল্পনা করে - ইস্! আমি যদি ম্যামের মতো হতে পারতাম তাহলে উনি আমার বন্ধু হতেন। কী ভালোই না হতো। এমন পরিপাটি করে শাড়ি পরা, অলংকারে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া, কপালের ঠিক মাঝখানে একটি মানানসই টিপ, ডালিম রঙের হালকা লিপস্টিকে সজ্জিত পাতলা ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মিষ্টি হাসি এবং আয়ত চোখদুটিতে কাজলের টান, যা জনম জনম ধরে দেখলেও তৃষ্ণা মেটে না। তার ওপরে একখানি কালো রঙের রোলস রয়েস-এর মতো নিখুঁত শরীর - যেন জীবনের সব হিসেবকে ওলট-পালট করে দেয়।

- নাহ্ সাগরটা যে কী! এখনও পাত্তা নেই।

ট্রেন আসার সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে স্টেশন মাস্টার ঘোষণা করলেন - "থ্রি সিক্সটি সেভেন আপ কৃষ্ণনগর লোকাল এক নম্বর প্লাটফর্মে আসছে"।

বিতান সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দেখতে পেল ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে। বিতান নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ট্রেন প্লাটফর্মে প্রবেশ করে। তিন নম্বর কামরাটা ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ট্রেনে অসম্ভব ভিড়, পা রাখার জায়গা নেই। বিতান হালকা-পাতলা শরীরটাকে সেই ভিড়ের মধ্যে গলিয়ে দিল। দু'একজন অবশ্য বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, "এই ছেলে, এত ভিড়ে কোথায় যাস? মাত্র তো দুটো স্টেশন, গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে থাক না"।

গেটের মুখে দাঁড়াতে বিতানের বড্ড ভয় করে। এই তো গতবছর রাসের দিনে ওদের কলেজেরই একটা ছাত্র এইরকম সাংঘাতিক ভিড়ে কোনোক্রমে গেটের মুখে ঝুলে কলেজে যাচ্ছিল। তাহেরপুর এবং বাদকুল্লা স্টেশনের মাঝখানে একটা পোস্টে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। বিতানের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা ও কিছুতেই ভুলতে পারে না। তাই কষ্ট, বিরূপ মন্তব্য, প্রচন্ড চাপ এবং সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ও ভিতরে চলে আসে। বারবার সাগরের কথা মনে পড়ে, ও আসেনি ভালোই হয়েছে। এই ভিড়ে একেবারে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যেত। তাছাড়া সাগর ওর মতো রোগাপটকা নয়, হেলদি এবং গাট্টাগোট্টা চেহারা। ওর চেহারার সাথে মণিদীপা ম্যামের চেহারার মিল পাওয়া যায়। অবিনাশবাবু ওকে নিয়ে মজা করে বলেন, "হ্যাঁরে সাগরিকা, তুই কী এম.ডি.-র মায়ের পেটের বোন? দুজনকেই একই রকম দেখতে"?

সাগর মুখ টিপে হাসে। কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ও অবিনাশবাবুর ফ্যান। একদিন ক্লাসের সবার মধ্যে বলেই ফেলে, "দেখিস আমি সত্যি সত্যি অবিনাশ স্যারের সাথে প্রেম করব"।

ভাগ্যিস অবিনাশবাবু কথাটা শুনতে পাননি। শুনতে পেলে কী হতো বলা যায় না। সাগর বলে, "কী হবে আবার। একটু জ্ঞান শুনতে হবে, কানের বারোটা বাজবে বৈ তো নয়। আমার জন্য নাহয় একদিন তোরা সবাই মিলে শুনবি"।

হ্যাঁ। সাগরের বুকের পাটা আছে বলতে হবে। স্যারকে সরাসরি একদিন জিজ্ঞেস করে বসলো,

- স্যার আপনি বিয়ে করেছেন?

- কেন?

- কিছু না স্যার। নিছক কৌতূহল।

স্যার সদুত্তর দেননি। কেবল মুখ টিপে হেসেছিলেন। সাগরের ছত্রিশ বুক বিয়াল্লিশ হয়ে গিয়েছিল। কথাটা বলতে পেরেছে এটাই ঢের, বাকিটা ধীরে ধীরে হবে। বিতান ওকে বলেছিল, "সত্যি সাগর, তুই একটা ঠোঁটকাটা, স্যারকে এভাবে বললি কীভাবে"?

সাগর হেসে বলে, "কেন তোর হিংসে হচ্ছে নাকি"?

- আমি খামোখা হিংসে করতে যাবো কেন? আমি তো তোর এই সাহসিকতাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করছি।

ঐশী ম্যামের ঠোঁটদুটো ক্রমাগত ওঠানামা করছে। এতক্ষণ সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ম্যামের দিকে তাকিয়ে তাঁর শরীরী ভাষা কীভাবে নতুন ছন্দে অবগাহন করছে এবং তার সাথে অলঙ্কারগুলো একটা নির্দিষ্ট ছন্দে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে তা রীতিমতো ওকে অবাক করে দেয়। আজ হলুদের ওপর সবুজ রঙের নকশা করা তাঁতের শাড়ির সাথে সবুজ রঙের ব্লাউজ ঐশী ম্যামকে একটা নতুন রূপ দিয়েছে। মাঝে মাঝে ম্যামের সাথে চোখা-চোখি হতেই বিতান চোখ ফিরিয়ে নেয় অথবা মাথা নীচু করে চুপচাপ শান্ত গোবেচারার মতো বসে থাকে। ম্যাম এটা লক্ষ্য করেছেন। তাঁর পনেরো বছরের চাকরির জীবনে এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায়নি। ক্লাস শেষ হলে তিনি বিতানকে ডেকে নেন কিছু একটা বলার জন্য। দুরুদুরু বুকে বিতান ঐশী ম্যামের ঘরে প্রবেশ করে। কলেজের এই ঘরখানি ম্যামের একান্ত নিজস্ব। এখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। কলেজের পূর্ব প্রান্তে চোরাকুঠুরির মত এই ঘরে তিনি নির্জনে বসে পড়াশোনা করেন। কেউ যাতে বিরক্ত না করে তার জন্য এই ব্যবস্থা। বিতানকে বসতে বলে তিনি উঠে দাঁড়ান। বিতানের কাছে এসে বলেন, "বিতান, তুমি ক্লাসে ওইভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলে কেন"?

বিতান জোরে একটা নিশ্বাস টেনে বলে, "ম্যাম, আমি মন দিয়ে আপনার পড়ানো শুনছিলাম"।

- তাই নাকি! আমি তোমার চাহনিতে অন্য কিছু দেখতে পেলাম। তাই তোমাকে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলাম।

বিতানের বুকের গোপন খাঁচায় বন্দী আছেন ঐশী ম্যাম। ম্যাম ঠিক ধরেছেন। ওর ইচ্ছে করছিল সবটা উজাড় করে ম্যামকে বলে মনটাকে হালকা করে নিই। কিন্তু সাহস পেল না। ভাবলো - ওর মনের ভেতর যে দুটি কাজল নয়ন হরিণীর মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে বাইরে বের করাটা ঠিক হবে না। সেই চকিত চাহনি বেরিয়ে পড়লে মহাকাশের কোন সুদূরে পাড়ি দেবে তা বলা যায় না। তার চেয়ে বরং বুকের ভেতর বন্দী হয়েই থাক।

ম্যাম একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, "দেখো বিতান এই বয়সটা আমারও ছিল। অনেক স্বপ্ন দেখতাম। মনের চোরা কুঠুরিতে কাউকে কাউকে সযত্নে রেখে দিতাম। ইচ্ছে করত সবটা বলে মনটাকে হালকা করি। কিন্তু বলতে পারিনি কাউকেই, মানে আমার কোনো মনের মানুষকে। ভয় করত। সে ভয় আজও আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়"।

বিতান লক্ষ্য করল ম্যামের কাজল কালো দুটি চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ দুটি মুছে নিলেন। বিতান ম্যামের কাছে এসে দাঁড়ালো।

- ম্যাম আপনার চোখে জল! আপনি কাঁদছেন?

- কই না তো। এমনি চোখে জল এসে গেল। হ্যাঁ, বিতান যাও মন দিয়ে পড়াশোনা করো। তুমি খুব ভালো ছেলে জানি। তোমার নামের মর্যাদা রেখো।

- কিন্তু ম্যাম - আপনার সুন্দর চোখদুটিতে জল - কেমন একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিল।

ঐশী ম্যাম বিতানের কাছে এসে ওর হাত দু'খানি টেনে নিলেন। নিজের কুসুমকোমল ঠোঁট দু'খানি দিয়ে একটা চুমু খেয়ে বললেন, "এটার মধ্যেই আশা করি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে"।

- ম্যাম, তবুও অন্তত একবার আমাকে বলবেন না?

- কিছু কিছু কথা থাকে যা বলা যায় না। কেবল অনুভব করতে হয়। আমি তোমাকে অনুভব করার সূত্র দিয়েছি, পারলে খুঁজে নিও।

ঐশী ম্যাম বিতানের আরও কাছে এসে বললেন, "একবার আমার চোখের দিকে তাকাও"।

বিতান ম্যামের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল কাজল কালো চোখদুটিতে লুকিয়ে আছে সুগভীর রহস্যের অভিব্যক্তি। কিন্তু সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ওর শরীর মন এবং সমস্ত অনুভূতিকে বিবশ করে দিচ্ছে। আর কিছুটা সময় এখানে থাকলে সে হয়তো নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।

বিতান যখন ম্যামের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তখন দেখতে পেল সাগর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে।

- কী রে বিতান তুই ম্যামের ঘরে? ম্যাম তো সাধারণত ওঁর ঘরে কাউকে ঢুকতে দেননা।

বিতান সাগরিকার কথার কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুতপদে করিডোর দিয়ে বেরিয়ে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাগরিকা চোখ বন্ধ করে দেখতে পেল দুটি কাজল চোখের গভীর অন্ধকারে বিতান যেন কী একটা খুঁজে চলেছে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।