আমার বড়োমামা ছিল একদম সহজ, সরল, ভোলা-ভালা মানুষ। যে কোনো কথা খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিত। তলিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজন বোধই করত না। ফলে বড়োমামাকে নানা রকম মিথ্যে বলে আমি মাঝেমাঝে ঠকাতে চেষ্টা করতাম। আর আশ্চর্য এটাই, আমি যাই বলি না কেন মানুষটা তা ধ্রুবসত্য হিসেবে মেনে নিত। যেমন মনে পড়ে, বড়োমামার সঙ্গে কি কারণে যেন এক সন্ধ্যায় সানগ্লাস নিয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ আমি বললাম, "জানো তো বড়োমামা, এখন আবার সানগ্লাসের মতো মুনগ্লাসও বেরিয়েছে। তুমি যখন রাত্রে ঠাকুরবাড়ি থেকে ফেরো, দেখবে এই রকম চশমা এখন অনেকেই পরছে"। শুনে বড়োমামা বলল, "চশমার কাচের রংটা কি বল তো"?
আমি বললাম, "একদম কুচকুচে কালো"। বড়োমামা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, "ঠিক বলেছিস। রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে মাঝেমাঝে দেখি বটে, চোখে কালো চশমা পরে দু' একজন হাঁটছে। তাহলে ওটাই মুনগ্লাস"!
এই হল আমার মাটির মানুষ, অকৃতদার বড়োমামা। কারও সাতে পাঁচে কখনও কোনোদিন থাকতে দেখিনি। মাথা অত্যন্ত ঠাণ্ডা। যে কোনো কাজে অত্যন্ত ধীর স্থির। বাগানে ফুলের গাছ লাগাচ্ছে তো লাগাচ্ছেই। এ দিকে দুপুরের ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
স্কুল থেকে ফিরে আমি বড়োমামার সঙ্গে রোজ ক্যারম খেলতে বসতাম। লেত্তি জড়িয়ে লাট্টু ঘোরানোও বড়োমামা শিখিয়েছিল। হাতলেত্তি, পালেত্তি, ইঁদুরলেত্তি, উড়নলেত্তি আরও কত ছিল আজ আর মনে নেই। বড়োমামা সব ক'টাতেই এক্সপার্ট। আমি অবশ্য এতো কিছু পারতাম না। একমাত্র হাতলেত্তিটা ভালোভাবে শিখে নিয়েছিলাম। বন্ধুদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতাম। লেত্তি ধরে হ্যাঁচকা টান মারলে লাট্টুটা শূন্যে উঠে যেত। তারপর ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসত ডান হাতের চেটোর ওপর। এটা আমার খুব ভালো লাগত। একবার তো ঘরের মধ্যে হাতলেত্তি প্র্যাকটিস করতে গিয়ে টিউবলাইটের কাঁচই ভেঙে ফেললাম। সে এক হৈ হৈ কাণ্ড। তখন শীতকাল। আমি একটা কানঢাকা উলের টুপি পরে ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি। বাবা টুপির ওপর দিয়েই ডান কানটা বেশ কয়েকবার মুলে দিল। মা-র রাগ গিয়ে পড়ল বড়োমামার ওপর।
- বড়দা এই সব অলক্ষুণে খেলা আপনি ওকে শেখাচ্ছেন। দেখুন, টিউবলাইট ভেঙে ফেললো। এখন কি হবে?
বড়োমামা আধঘণ্টার মধ্যে নতুন টিউবলাইট কিনে এনে জ্বালিয়ে দিল। ব্যাস সমস্যার সমাধান।
কালীপুজোর দিন দশেক আগে থেকেই আমাদের বাড়িতে শুরু হয়ে যেত উৎসবের আনন্দ। দুর্ধর্ষ বাজি বানাতে পারত বড়োমামা। ঝুড়ি ঝুড়ি রংমশাল, বসনতুবড়ি, বোম আর পটকা বানানো হতো। উড়নতুবড়িও বানানো হয়েছিল কয়েকবার। আমি আর আমার দুই যমজ বোন এতো বাজি পুড়িয়ে শেষ করতে পারতাম না। তাই পাড়ার অনেককেই সেগুলো বিলোতে হতো। একবার আমি বায়না ধরলাম, এ বছর দোদমা বানাতে হবে। এটা বড়োমামা আগে কখনও বানায়নি তাই প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু ছোটমামার চাপে পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া একটা বই খুলে কয়েকদিন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করল। শুনেছিলাম বইটা আমার দাদুর কেনা। ওপরে বড়ো বড়ো করে লেখা - 'বাজি বানাবার কৌশল'। সে বছর দোদমা তৈরী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বেশ কয়েকটা দু'বার না ফেটে একবার ফাটল অর্থাৎ একদমা। যদিও সেগুলোর আওয়াজও কিছু কম ছিল না। বাজি বানাবার বইটা আমি মাঝেমাঝে পড়তাম। তাতে কতো রকম মশলার নাম। সোরা, গন্ধক, পটাশ, মোমছাল, লোহাচুর, ম্যাগনেশিয়াম চুর আরও কতো কি! কালীঘাট বাজার থেকে এইসব মশলা আমার দুই মামা কিনে আনত। তারপর সেগুলো লোহার বিশাল হামানদিস্তাতে গুঁড়ো করা হতো। বাজি অনুযায়ী মশলার ভাগ মাপার জন্য ছিল একটা পেতলের ছোট নিক্তিপাল্লা। এই জিনিষ স্যাকরার দোকানেও ব্যবহার করা হয়। তবে পটাশ আমি কখনও দেখিনি। বাজারে তখন পটাশ বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। বড়োমামা যতোটা ঠাণ্ডা মানুষ, ছোটমামা ছিল কিন্তু ঠিক তার উল্টো। যাকে বলে ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের। তাই মাঝেমাঝে মশলার ভাগে ভুলভাল ঘটিয়ে ফেলত। তবে ছোটমামার হাত ছিল মারাত্মক ফাস্ট। আধ ঘন্টায় ধীরে সুস্থে বড়োমামা হয়ত পনেরোটা রংমশালের খোলে মশলা ভরল। আর এদিকে ছোটমামার চল্লিশটা কমপ্লিট। তার মধ্যে আমরা গোটা চারেক জ্বালিয়েও ফেলেছি।
বড়োমামা বৈষ্ণব না হয়েও কণ্ঠী ধারণ করেছিল। আর গান্ধীমার্কা সোনালী চশমাটা ছিল লা-জবাব। যেহেতু ঈশ্বরমনস্ক মানুষ তাই হাজরার রাধা-গোবিন্দ মন্দিরে নাম-সংকীর্তনের আসরে প্রতি সন্ধ্যায় হাজির হতো বড়োমামা। অন্য অনেকের সঙ্গে করতাল বাজিয়ে ঠাকুরের নাম-গান করত। আমাকেও বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছে। শুনেছি অনেকেই এই মন্দিরটিকে বলত ঠাকুরবাড়ি। বিশাল দাওয়ার ওপর ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকত। মাথার ওপর জ্বলত ঝাড়লণ্ঠন। প্রতি বছর নিয়ম করে ঠাকুরবাড়িতে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। পরপর চার দিন চলত 'নৌকোবিলাস', 'সুবল মিলন', 'মান ভঞ্জন' আর 'নিমাই সন্ন্যাস'। তবে কোনো বৈচিত্র্য ছিল না কারণ একই চারটি পালা প্রতি বছর হতো। এমনও হয়েছে যে বড়োমামার পাশে বসে যাত্রা দেখে বাড়ি ফিরেছি রাত এগারোটায়। কয়েকবার দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি।
বড়োমামার দিন শুরু হতো ঠাকুরকে জল, বাতাসা দিয়ে। তার আগে কপালে আর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গোপী চন্দনের ফোঁটা আঁকত। বুকের ঠিক মাঝে চন্দন দিয়ে আঁকত শ্রীকৃষ্ণের চরণ যুগল। তারপর একা একাই গাইতে শুরু করত বিভিন্ন ভজন, কখনও বসে কখনও বা দাঁড়িয়ে। কণ্ঠস্বর ক্রমশ উঁচুতে উঠত। তখন বড়োমামা যেন এক অন্য মানুষ। দু' চোখ থেকে ঝরঝর করে জল ঝরছে। শরীরে অদ্ভুত এক কম্পন। আমি যত দেখতাম, অবাক হয়ে যেতাম। কখনও বা ভজন গাইতে গাইতে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নাচতে শুরু করত বড়োমামা। যেন আর নিজের মধ্যে নেই। নাচতে নাচতেই মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে ওলট পালট খেত। এই দৃশ্য আমি অনেকবার দেখেছি। তবে খুব আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে অতো বড়ো মানুষটা পড়ে যাবার পরেও এতটুকু আঘাত পেত না। দিদা পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে বড়োমামাকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করাতো। এই ঘোর কাটতে সময় লাগত বেশ কিছুক্ষণ। এই যে পড়ে যাবার পরেও কোনো চোট, আঘাত লাগত না, এটা আমাকে বিস্মিত করেছে বহুবার। এই নিয়ে প্রশ্নও করেছি।। বড়োমামা বলত, ওই সময়ে মেঝেতে ঠাকুর পদ্মফুল বিছিয়ে রাখে। তাই শরীরে কোনো ব্যথা লাগে না। আজ আমার মনে হয় ওই সময়ে বড়োমামার শরীরে সম্ভবত চলে আসত এক প্রবল অন্য রকম এনার্জি। আর সেটাই আঘাতের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিত। আধ্যাত্মিকতা বেশ বড়ো একটা বিষয়। আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানিও না। শুধু যুক্তিসঙ্গত যেসব কারণ খুঁজে পাই সেগুলোর ওপরেই বিশ্বাস রাখতে ইচ্ছা করে। আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে তাহলে প্রেতেরও অস্তিত্ব আছে। অথবা দুটোরই কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ একটা গুড এনার্জি আর অন্যটা ব্যাড।
একবার শারীরিক কি একটা সমস্যার কারণে মাকে ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। বড়োমামা কোথাকার কোন ডাক্তারখানা থেকে এক বৃদ্ধ কম্পাউণ্ডারকে ডেকে আনল। ভদ্রলোকের মাথায় বিশাল টাক। দেখতে একদম অভিনেতা সন্তোষ দত্ত-র মতো। আমার দুই বোন ওঁকে দেখে মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। আমি মনে মনে ভাবছি এই স্যাম্পলটিকে আবার বড়োমামা কোথা থেকে জোগাড় করল! পাড়ার সব ডাক্তারখানাই আমার চেনা। এই মুখ কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। যাই হোক, ভদ্রলোক অ্যাম্পিউল ভেঙে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরছেন, ঘরের বাইরে বড়োমামা আমাকে বলল, "ওঁকে চিনিস? ইঞ্জেকসনে দারুণ হাত। এমন পুস করবে যে ব্যথা টেরই পাবে না"। আমি বললাম, "হ্যাঁ, চিনি। এই তো সেদিন আমার বন্ধু টুলুর মাকেও উনি ইঞ্জেকসন দিলেন"। পুরোটাই মিথ্যে কথা। কিন্তু বড়োমামা বিশ্বাস করে নিল। ফিসফিস করে বললো, "ভদ্রলোকের নামটা জানিস"? আমি গম্ভীরভাবে বললাম, "জানবো না কেন! ওঁর নাম বেচারাম বাগচী"। এরপর একটা দারুণ কাণ্ড ঘটলো। ভদ্রলোক মাকে সুঁচ বিঁধিয়ে সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন, বড়োমামা ঘরে ঢুকে ওঁকে সটান বললেন, "বেচারামবাবু আপনাকে কত দেবো"? এ রকম একটা ঘটনার জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম ভদ্রলোকের চোখদুটো মুহূর্তের মধ্যে রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেলো। কোনোরকমে বিষম সামলে বললেন, "পাঁচটা টাকা দিন"।
প্রায় বিরাশি বছর বয়সে আমার এই ধর্মপ্রাণ বড়োমামার মৃত্যুর যোগসূত্র তৈরী হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। তখন আমি একটা বিখ্যাত বাংলা কাগজের বিজ্ঞাপন বিভাগে চাকরি করি। সেদিন কি কারণে যেন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোবার সুযোগ হয়েছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম বেশ থমথমে পরিবেশ। সকলেই কেমন যেন চুপচাপ। পাড়ার মধ্যে আমাদের বাড়ি হৈ চৈ করার জন্যে বিখ্যাত। বুঝলাম নিশ্চিৎ কিছু একটা ঘটেছে। বারান্দায় বসে জুতো খুলছি, মা আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
- শোন, একটা খুব বাজে ঘটনা ঘটে গেছে।
আমি এরকমই কিছু একটা আশা করছিলাম। জানতে পারলাম যে বড়োমামা খাট থেকে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের হাড় ভেঙেছে। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। তিনি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়ে গেছেন ঠিকই কিন্তু একজন অর্থোপেডিককে দেখাতেই হবে। ঘরে ঢুকে দেখি বড়োমামা খাটের ওপর শুয়ে আছে একদম নিথরভাবে। মনে হল ঘুমোচ্ছে। ডান পায়ে হাঁটুর নীচে জড়ানো ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ। একটা কাঠের চেয়ারে ছোটমামা বসে আছে খুবই উদ্বিগ্ন মনে। আমাকে দেখামাত্র বড়োমামা বলে উঠল, "সবই কপাল বুঝলি! যা কপালে আছে তাই তো ঘটবে"!
পুরো ঘটনাটা ছোটমামার মুখে শুনলাম। তা হলো - ঘরের বাল্বটা হঠাৎ কেটে যাওয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। বড়োমামা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাল্ব কিনে আনে। তখন ছোটমামা বাড়িতে ছিল না। মা অনেকবার বলে, "এখন ঘরে মোমবাতি জ্বলুক। আপনার ভাগ্নে অফিস থেকে ফিরে হোল্ডারে বাল্ব আটকে জ্বালিয়ে দেবে"। কিন্তু বড়োমামা সে কথা না শুনে নিজেই ওই মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় হোল্ডারে বাল্ব আটকাবার জন্য বিছানায় ওঠে। আলো জ্বালিয়েও দেয়। কিন্তু নামার সময়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় মেঝের ওপর। ডান পায়ে মারাত্মক চোট লাগে। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারে যে পা ফেলে দাঁড়াতেই পারছে না। আধঘণ্টা পরে ছোটমামা ফিরে আসে ও একজন ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনে। তিনি দেখেই বলেন যে পায়ের হাড় ভেঙে গেছে।
পরদিন অফিস ছুটি নিতে হল। বড়োমামাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে গেলাম সরকারি হাসপাতালে। অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টে খুব ভিড়। বড়োমামা একদম ভেঙে পড়েছে। একবার খুব নীচু গলায় বলল, "বুড়ো বয়েসে এ কেমন ভোগান্তি বল তো! এই হাড় কি আর জুড়বে"! আমি মনে জোর দেবার জন্যে একটা মিথ্যে কথা বললাম। এ রকম কতো মিথ্যেই তো এতো দিন বলে এসেছি। কিন্তু আজ ঠকিয়ে মজা করার জন্য নয়। বললাম, "তিন মাস আগে আমার বন্ধু সুমন্তর বাবার হাত ভেঙেছিল। তাঁরও বয়েস প্রায় তোমার মতো। হাড় কিন্তু দিব্যি জোড়া লেগে গেছে"।
বড়োমামা চুপ করে শুনল। মনে হল এই প্রথম আমার এই মিথ্যাকে তেমন গুরুত্ব দিল না। বলল, "কে জানে! আমার হাড় বোধহয় জোড়া লাগবে না। অনেক পাপ করেছিলাম রে"! ডাক পড়তে ঢুকলাম ডাক্তারের চেম্বারে। বড়োমামাকে বিছানায় শুইয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর ডাক্তারবাবু আমাকে বললেন, "হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। একটা বড়ো ওজনের লোহার চাকতি পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। একে বলে ট্র্যাকসন পদ্ধতি। এইভাবে প্রায় একমাস হাসপাতালে থাকার পরে আবার পরীক্ষা করে দেখা হবে হাড় ঠিক মতন জোড়া লাগল কি না। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই"। আগের ওষুধগুলো বন্ধ করে দিয়ে নতুন কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন ডাক্তারবাবু।
পরের দিনই বড়োমামাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। এমনিতে সরকারি হাসপাতালে সহজে বেড পাওয়া যায় না। কিন্তু ওই অর্থোপেডিকের রেফারেন্সেই ভর্তির ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আমাকে কিনে আনতে হল একটা দড়ি বাঁধা বিশাল ওজনের লোহার চাকতি, একটা লোহার স্ট্যান্ড ভাঙা পা শুইয়ে রাখার জন্য আর প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো।
পায়ে দড়ি বেঁধে ওই বিশাল ওজনের লোহা ঝুলিয়ে রাখা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। অথচ এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। আমি জানতাম, ট্র্যাকসন অনেকেই নিতে পারে না। এই কষ্ট সহ্য করা খুব কঠিন। তারপর আবার বিরাশি বছর বয়সে।
আমাকে নিয়মিত অফিস করতে হতো। তাই রোজ হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হতো না। এই দায়িত্ব পালন করত মা আর দুই বোন। একজন অ্যাটেনডেন্টও রাখা হয়েছিল। মা বলত, "তোর বড়োমামার পায়ে মাঝে মাঝে এমন ব্যথা উঠছে যে কেঁদে ফেলছে। এই দৃশ্য দেখা যায় না। ওষুধ খেলে কিছুক্ষণের জন্য ব্যথা কমে। কি ভাবে যে এক মাস কাটাবে কিছু বুঝতে পারছি না"। দিন দশেক পরে এক বিকেলে বড়োমামাকে দেখতে গেলাম। চোখে পড়ল, চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। গায়ের শার্টটা ঢলঢল করছে। আমাকে দেখে একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, "বাড়ি নিয়ে চল। এতো কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আর হাড় জোড়া লাগানোর দরকার নেই। শেষ ক'টা দিন না হয় বিছানায় শুয়েই কাটিয়ে দেবো। তোরা তো সকলেই আছিস"। বড়োমামার কথাগুলো শুনে আমার চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল। তবু বললাম, "আর ক'টা দিন একটু কষ্ট করে থাকো। দেখো, একদম সেরে উঠবে"।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। যে মানুষটা সারা জীবন ঈশ্বর সাধনায় কাটিয়ে দিল, কারও উপকার ছাড়া অপকার কখনও করেনি, তাকে শেষ জীবনে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে কেন? তাহলে কি এটাই পূর্বজন্মের সংস্কার! কথায় বলে, তুমি যদি অপরাধ কিছু করে থাকো, এই জন্মে না হলেও তার ফল পরের জন্মে ভোগ করতে হবে। সেটাই কি তাহলে সঠিক! বড়োমামা কি পূর্বজন্মে সত্যিই কোনো পাপ করেছিল! পরক্ষণেই ভাবলাম, আমি তো আগে ঠাকুর-দেবতার কনসেপ্টে বিশ্বাসী ছিলাম না। অথচ এখন জন্মান্তর নিয়ে ভাবছি। তার মানে বয়স বাড়ছে। বয়সের সঙ্গে তাল রেখে মানুষও পাল্টে যায়। কয়েক দিন পরে শুনলাম বড়োমামা খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এই লক্ষণ খুব একটা ভালো নয়। এটা মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ বলেই আমার মনে হল। এরপর এক বিকেলে অফিসে ছোট বোন টেলিফোন করে জানালো বড়োমামা আর নেই। আমি একটুও অবাক হইনি। মানুষ কোনো একদিন থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে মৃত্যুর যোগসূত্র যেভাবে তৈরী হল সেটা বেশ বিস্ময়জনক। সেদিন যদি ঘরের ওই বাল্বটা না কাটত তাহলে নিশ্চিত বড়োমামা আরও কিছুদিন আমাদের মধ্যে থেকে যেত। অর্থাৎ সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তার পরিবর্তন ঘটাতে পারি না।
হাসপাতালে পৌঁছবার পর দেখি সে আরেক কাণ্ড। অলরেডি সেখানে লোকাল থানা থেকে পুলিশ চলে এসেছে। সেই অর্থোপেডিক বললেন, "বডি পোস্টমর্টেম হবে। ভর্তির সময়ে যে কেস হিস্ট্রি লেখা হয়েছিল তা নাকি সন্দেহজনক"। পুলিশের সঙ্গে কথা বললাম। ওঁরা জানালেন, "এই যে ভদ্রলোক খাট থেকে পড়ে গেছিলেন সেটা কেউ ধাক্কা দিয়েও ফেলে দিতে পারে। তাই একটা রুটিন ইনভেস্টিগেশন হবে"। অনেক অনুরোধ করলাম কিন্তু কোনো কাজ হল না। বড়োমামার মৃতদেহ সেই রাত্রে হাসপাতালের মর্গে রেখে দেওয়া হল। পরদিন বেলার দিকে থানা থেকে একজন অফিসার বাড়িতে এলেন। ঠিক যেখানে বড়োমামা পড়ে গিয়েছিল খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর চা খেতে খেতে বললেন, "আমরা সবই বুঝি। কিন্তু ইনভেস্টিগেশনে আসতেই হয়। এটাই নিয়ম। আমার বাবাও বৃদ্ধ বয়েসে কারও কথা শুনতেন না। আর উনিও জেদ করেই এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়েছেন"। যাই হোক হাসপাতালের মর্গ থেকে ডেড বডি বের করে সোজা চলে যান মোমিনপুরের কাঁটাপুকুর মর্গে। সেখানেও একটা রুটিন পোস্টমর্টেম হবে।
আমি ও আমার দুই বন্ধু সুব্রত আর দেবাশিস এক ঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম হাসপাতালের মর্গে। সেখান থেকে বডি বার করে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে রওনা দিলাম কাঁটাপুকুর মর্গ। গাড়ি ভেতরে ঢুকতেই দুজন ডোম বডি নামিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। কতক্ষণ লাগবে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের মতো আরও অনেকেই অপেক্ষা করছে। আমরা এক প্রস্ত চা খেয়ে ফিরে এসে দেখি দারোয়ানের ঘরের জানলার সামনে মানুষের জটলা। ইণ্ডিয়া আর ইংল্যান্ডের মধ্যে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলছে। সেটাই দেখার জন্যে এই ভিড়। বুঝলাম, মানুষ চলে গেলেও পৃথিবীর কোনো কিছুই বদলায় না। সব কিছুই ঘটতে থাকে রুটিন মাফিক। আমরাও টিভির পর্দায় চোখ রাখলাম। তারপর এলো সেই চিত্তাকর্ষক মুহূর্ত। স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে যুবরাজ সিং-এর ছ'টি ছক্কা।
কিছুক্ষণ পরে একজন ডোম এসে আমাদের ডাকল। এক ঝলক দেখেই বুঝলাম লোকটি গলা অবধি মদ খেয়েছে। যে ঘরে বডি কাটা-ছেঁড়া করা হয় আমরা সেই ঘরটির সামনে দাঁড়ালাম। মিনিট পাঁচেক পরে দেখলাম আরেক জন ডোম বড়োমামার দেহটা টানতে টানতে নিয়ে আসছে। দেহটা কোলাপসিবল গেটের সামনে ধপ করে ফেলে দিতেই মাথাটা সজোরে ধাক্কা খেলো লোহার গেটে। ডোমটি বলল, "বেশী কাটাকাটি করতে হয়নি। বুকের এক পাশে সামান্য ছুরি বসিয়ে সেলাই করে দিয়েছে"। দুজনকে একশো, একশো দুশো টাকা দিতে হল। আমি অবশ্য অনেক খুঁজেও মৃতদেহের বুকে কোনো কাটা দাগ বা সেলাই-এর চিহ্নও খুঁজে পেলাম না। ম্যাটাডোরটাকে তখনও আমরা আটকে রেখেছিলাম। দেবাশিস অনেক খুঁজে একটা মার্কিন কাপড় আর কিছু ফুল কিনে আনল। সেই কাপড়ে বড়োমামার শরীর জড়িয়ে ম্যাটাডোরে তোলা হল। ফুলগুলো ছড়িয়ে দিলাম কাপড়ের ওপর। এবার গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশান।
হাসপাতালে বড়োমামা ছিল মোট তেইশ দিন। ঠিক মতন খাওয়া দাওয়া না করার কারনে শরীর একদম ভেঙে পড়েছিল। চুল্লিতে বডি ঢোকাবার পর সময় লাগল চল্লিশ মিনিট। পিছনের লোহার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখলাম চারজন ডোম দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে একটা লোহার পাত্রে কিছু ছাই আর কাঠ-কয়লার মতো কি সব যেন ছড়ানো ছেটানো। ওদের মধ্যে একজন বেশ মুরুব্বির চালে বলল, "নাভি নেবেন তো! পাঁচশো টাকা লাগবে"।
এই নাভি ব্যাপারটা আমাকে বারবার অবাক করেছে। নাভি নাকি আগুনে পোড়ে না। এই রহস্য আজও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তাছাড়া এই ব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যাখ্যাও আমার জানা নেই। আমি বহুবার দেখেছি, নাভির নাম করে ডোম ছাই ঘেঁটে যেটা তুলে আনে দেখতে অনেকটা ভাঙা হাড় বা কাঠ-কয়লার মতো। যাই হোক আমরা বললাম দু'শো টাকা দেবো। কিন্তু লোক চারটে কিছুতেই রাজি নয়। এদিকে আমারও জেদ বাড়ছে। এরা একটু নরম হলেই পেয়ে বসে। আবার বললাম, "ভাই যাই বলো না কেন দু'শো টাকার এক পয়সাও বেশী দেবো না"। আসলে এটা আমার কৃপণতা নয়। লোকগুলোর কথা শুনে মনে হচ্ছিল জোর করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করার ধান্দা এবং এই কাজ ওরা হামেশাই করে। সব শেষে এক ডোম বলে উঠল, "পাঁচশো টাকা না দিলে নাভি দেবো না"।
এবার সুব্রত একটা কাণ্ড ঘটাল। লোকটাকে সটান বলল, "ভাই দু'শোর এক পয়সা বেশী দেবো না। তাতে নাভি দেবে তো দাও না হলে ওই নাভি তোমার বাড়ির আলমারিতে তুলে রাখো। আমরা চললাম। তবে আমি শুনেছি ওটা দিতে হয়। না দিলে যদি কিছু ঘটে তার জন্যে কিন্তু আমরা দায়ী থাকব না। আমি ব্রাহ্মণের ছেলে। ভুলভাল কথা বলি না"। সুব্রত গেঞ্জির ভেতর থেকে ওর পৈতে বার করে হাত দিয়ে চেপে ধরল। আমরা তিনজনেই বড়োমামার নাভি না নিয়েই ফিরে আসছিলাম সুব্রতর কথায়, কিন্তু ম্যাজিকের মতো কাজ হল। এবার ডোমটি অত্যন্ত নরম গলায় বলল, "অভিশাপ দিচ্ছেন কেন? আচ্ছা দু'শোই দিন আর নাভি নিয়ে যান"।
মালসায় বড়োমামার নাভি রেখে তার ওপর মাটি চাপিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলাম। তখন সবে সন্ধ্যে হয়েছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, কিছু সংস্কার বেঁচে আছে হয়ত কিছু ভালোর জন্যেই। না হলে বড়োমামার নাভির দাম পাঁচশো থেকে দু'শো টাকায় নামানো সম্ভব হতো না।