গল্প ও অণুগল্প

মুক্তি



মৌসুমি মৌ (বাংলাদেশ)


কী এক দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে মোরশেদ খান তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে, ঘৃণায় রি রি করছে তার শরীর। এই শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি ছোটোবেলায় ছেলেকে?

সে-সবও কী আর এখন মনে থাকার কথা। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি, সাব্বির সে-সবের কিছুই দেখলো না, কিংবা দেখলো৷ দেখেও না দেখার ভান করে আপন মনে মেয়েটার কাঁধে আঙুল বোলাতে লাগলো।

ঘর থেকে দেখছিলেন আফসানা বেগম, স্বামীর মুখে যন্ত্রণা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ কিছু বলতে চাইছেন বোধহয়। সেসবে ভ্রূক্ষেপ না করে তরকারি কাটাতে মন দিলেন, শিম আর আলুর ভাজিটা করতে হবে, মেয়েটা এলো তাই, নইলে যা আছে তাই দিয়ে দিব্যি চলে যেত তিনজনের সংসার। ছেলের এই বান্ধবী এসে জুটেছে অবেলায়, তাকে তো আর এক তরকারি দিয়ে ভাত দেওয়া যায় না। মেয়েটা একটু বেশি গা ঘেঁষা। কিন্তু তবু অপছন্দ করেন না আফসানা বেগম। কারণ মেয়েটা যখনই আসে তখনই হাতে করে তার জন্য পান, মিষ্টি, ছেলের বাবার জন্য ফলমূল হাতে করে নিয়ে আসে। এই অভাবের সংসারে এসব খুব দরকার, লোকটার শরীর দিনদিন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না তারা। মেয়েটা আসাতে যা একটু এসবের মুখ দেখেন। নইলে তো তিনবেলা ভাত জোটাতেই হিমশিম খান তারা।

ওদেরকে খেতে দিয়ে, একটা কমলা ছিলে নিয়ে আসেন তিনি স্বামীর জন্য। মোরশেদ খান কমলা মুখে পুরতে চান না। মুখ উলটে ফেলে দেন।

"ওসব ঢং কোরো না। ওসব ভাবলে আর বেঁচে থাকতে হবে না"। মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠেন আফসানা বেগম। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে মোরশেদ খানের। একরকম কেঁপে কেঁপে চাবাতে থাকেন কমলার কোয়াগুলোকে।

এবার সময় সুযোগ বুঝে এটা সেটার কথা বলতে থাকেন আফসানা বেগম, বলতে দ্বিধা হয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু না বলেও পারেন না। সাব্বিরের যা বেতন তা দিয়ে ওষুধ, চিকিৎসা এসবই ঠিকঠাক চলে না। আর সুযোগ থাকলে একটু ভালোভাবে বাঁচার আশা কে-ই না করে। এদিকে শর্মীর কিছুতেই মন ভরে না সাব্বিরের সাথে সময় কাটিয়ে। কখনো সখনো শর্মীর ইচ্ছে করে সোজা সাব্বিরকে ঘরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় বা বাড়ির বাইরে থেকে ঘুরে আসে। কিন্তু হয়না কিছুই, এসেই পড়তে হয় এই বুড়োর মুখোমুখি, তাকিয়ে থাকে ড্যাব ড্যাব করে। তাকে যে অপছন্দ করে স্পষ্টই বোঝা যায়। কিন্তু যে থেকে কোনো লাভ নেই, তার এসবের কোনো মূল্যও নেই। মূল্য আছে শুধু শর্মীর অনুভূতির। যেভাবেই হোক সাব্বিরকে পেতে চায় সে। মাঝেমধ্যে ভাবে সাব্বিরকে বিয়ের কথাটা বলেই ফেলবে। কিন্তু এই বাপটার জন্য, এসব সে পোহাতে পারবে না।

এদিকে সাব্বিরেরও মন বোঝা দায়, ডিভোর্সী সে, শরীর, মনের তাড়না তার নেই তা নয়। তবে মনকে বশে রাখতে জানে। তাছাড়া শর্মীর মতলবটা বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এমনি ভালোই মনে হয়, তবে সবকিছু কি মানিয়ে নিতে পারবে না-কি ক'দিনের জন্য ছেলেখেলা এসব।

এই বাপটার যত দোষ, নদী শুধু এসব যন্ত্রণা সইতে না পেরেই চলে গেল। কেই-বা সাত বেলা পক্ষাঘাতগ্রস্থ শ্বশুরকে নিয়ে টানাটানি করতে পছন্দ করে। মা তো এসব কিছুই করতো না। নদীর উপর একরকম অত্যাচারই চলতো। শেষমেশ না পেরে সাফায়েতের সাথে, বুঝতে বাকি ছিল না সাব্বিরের কিন্তু কীই বা করবে।

চেষ্টা করেছিল খুব। আসলে যতটা না ওকে রাখার তার থেকে বেশি ডিভোর্সের টাকাটা পরিশোধ করা নিয়ে চিন্তা ছিল। খুব অনুনয় বিনয় করতো, মাঝেমধ্যে মনে হতো বাপটাকে মেরে ফেলে, এভাবে নিজেও কষ্ট করে বেঁচে থাকবে, তাদেরকেও শেষ করে রেখে যাবে এমন মনে হতো।

কিন্তু পারেনি শেষমেশ, বাবা তো, ডিভোর্স দিয়েছে নদীকে, যা কিছু ছিল সব সম্বল ভাসিয়ে ডিভোর্স দিতে হয়েছে। সাফায়েতের সাথে সংসার করছে নদী, সুখেই আছে বোধহয়। একটা দীর্ঘনিঃস্বাস বের হয়ে আসে সাব্বিরের সুখ থেকে।

এই নতুন আপদটা এসে জুটেছে এতদিন পর, স্কুলের পর তো আর যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু সেদিন হঠাৎই রাস্তাতে দেখা, আর তারপর থেকেই তার প্রেম উতলে উঠছে। সাব্বিরেরও খারাপ লাগে না একটু ছোঁয়াছুঁয়ি করতে, কিন্তু কেন জানি এর বেশি যেতে রুচিতে বাঁধে। মেয়েটাকে কি বিয়ের কথা বলবে, কিন্তু ও যদি নদীর মতো করে?

তাই শেষমেশ আর এগোতে চায় না কিছুতেই। কিন্তু শর্মী নাছোড়বান্দা, সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে পারতপক্ষে বাড়িতে না থাকার চেষ্টা করে সে, লাভ হয় না। মাঝেমধ্যে মনে হয় মা ইচ্ছে করেই ওকে এটা সেটা বলে আটকে রাখে। ও বের হওয়ার আগেই প্রায় এসে হাজির হয়ে যায় মেয়েটা। ওর আর এসব ভালো লাগে না। মাকে কিছু বলতেও পারে না। আসলে বলা যায় না কাউকেই কিছু। বাবার স্পষ্ট অভিব্যক্তি বুঝতে বাকি নেই তার-ও। কিন্তু কী করবে সে! বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে তার নিজের জীবনটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন, মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়েছুড়ে সে চলে যায় নিজের মতো। কিন্তু তা-ও কি হয়?

আফসানা বেগমও হাঁফিয়ে উঠেছেন, আর পারেন না আজকাল। যতদিন বউটা ছিল তার ঘাড়ে সবকিছু চাপিয়ে একটু নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন। কিন্তু বউটা চলে যাবার পর থেকে তার যেন এক মিনিটের স্বস্তি নেই। এভাবে আর চলতে পারে না প্রতিদিনই ভাবেন তিনি। বাকি জীবনটা তিনি এভাবে কাটাতে পারবেন না। আর ক'টা দিনই বা বাঁচবেন, একটু শান্তিতে কি থাকতে পারবেন না?

দিন দিনে মোরশেদ খানও বুঝতে পারেন তাকে নিয়ে আর কেউ এগোতে পারছে না। সবার জীবনই থমকে আছে তার জন্য। সে না থাকলেই সবার জন্য হয়তো সুবিধা হয়। নিজের মৃত্যুর প্রার্থনা করেন সবসময়। কোনোভাবে যদি নিজেকে শেষ করে দিতে পারতেন, কিন্তু সেটাও তো পারেন না। জীবনের মায়া ছাড়া কি এতই সহজ!

যথারীতি এমনি এক ছুটির দিনে সন্ধ্যায় এসে হাজির হয় শর্মী। শর্মীর হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা মা-কে দিয়ে দেয় সাব্বির, আফসানা বেগম সেটা এনে স্বামীকে খাইয়ে দেন, খাওয়ার সময় স্বাভাবিকভাবেই মুখ উলটে ফেলে দিতে যান মোরশেদ খান। কিন্তু স্ত্রী'র চোখ রাঙানির ভয়ে খেয়ে শেষ করেন পুরোটাই। পরদিন সকালে মোরশেদ সাহেবের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। একজন মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটা নতুন ভোরের সূচনা হয় সবার জীবনে।

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।