গল্প ও অণুগল্প

মুকুলিকার দুই প্রেমিক



দ্বিজরাজ সান্যাল


সত্যেন আর দ্বিজেন। নাম শুনে দু-ভাই মনে হলেও, এরা মুকুলিকার দুই প্রেমিক। মুকুলিকার শরীরে এখনও যথেষ্ট ঠমক, রূপের চমকও বেশ। পাশাপাশি মেয়েটির মুখময় অদ্ভুত এক মায়া। গজদাঁত বের করে সে যখন ভুবন ভোলানো হাসি হাসে, দুনিয়ার সব সমস্যা যেন মুহূর্তে মিটে যায়। সত্যেন মুকুলিকার থেকে পাঁচ বছরের ছোট, আবার দ্বিজেন ওর প্রেমিকার থেকে দশ বছরের বড়।

মুকুলিকা জোর হুজুগ তুলেছে দুই প্রেমিককে নিয়ে সে দার্জিলিং বেড়াতে যাবে জানুয়ারির ঠান্ডায়। প্রস্তাব শুনেই প্রথমটা প্রবল খুশিতে হৈ-হল্লা জুড়ে দিয়েছিল দুই প্রেমিক। দিন দুই পরে উত্তেজনা কিছুটা কমলে দ্বিজেন ফোন করে মুকুলিকাকে অনুরোধ করে,

"মুকুল, বলছিলাম কী - আমাদের দার্জিলিং যাওয়াটা একটু এগিয়ে সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের প্রথমে করলে হয় না?"

"না গো হয় না। ওই সময় বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে, সঙ্গে ল্যান্ডস্লাইড। দার্জিলিং-এর রাস্তা বিপজ্জনক হয়ে থাকে। কিন্তু তোমার অসুবিধেটা কী শুনি।"

"না মানে বয়েস হয়েছে তো, বেশি ঠান্ডায় কাবু হয়ে যাই।"

"ও মা, এই ব্যাপার! - প্রথমে হেসে কুটোপাটি হয় মুকুলিকা। তারপর সহজ গলায় বলে,

"তোমাকে গরম রাখার দায়িত্ব আমার।"

দ্বিজেন জানে নিতান্ত সরলমনেই কথাটা বলেছে মুকুলিকা। এমনটা সে আগেও করেছে। তবু তার শরীরময় খেলে গেল এক অচেনা তরঙ্গ। মুকুলিকার প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়ল দ্বিজেনের।

ওদিকে সত্যেন মুকুলিকাকে ফোন করে বেশ ঝাঁঝালো গলায় জানতে চেয়েছে,

"তুমি দ্বিজেনদাকে কোন আক্কেলে দার্জিলিং নিয়ে যাচ্ছো? মানুষটার বয়েস হয়েছে, হাই ব্লাডপ্রেসার, কোলেস্টেরল আছে। পাহাড়ে গিয়ে যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন?"

"কেন, আমরা দুজনে মিলে আমাদের অসুস্থ বন্ধুকে সামলাতে পারবো না? শুধু দ্বিজেন কেন, আমি বা তুমিও তো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি। ওঃ বুঝেছি- বেড়াতে গিয়ে তুমি শুধু আনন্দ মানে মস্তি করতে চাও, কোন ঝক্কি পোহাবে না।"

মুকুলিকা হাসতে হাসতেই এমন স্পষ্ট কথা অনেক সময়ই বলে দেয়। বিপাকে পড়ে সত্যেন আমতা আমতা করতে থাকে। দুষ্টুমি করে মুকুলিকা তখন সত্যেনের মনের সত্যিটা বলে বসে ফস করে,

"আমি জানি সত্যেন, তুমি আমাকে একা পাওয়ার জন্যেই দ্বিজেনকে কাটাতে চাইছ।"

সত্যেন মৃদু আপত্তি জানায়। মুকুলিকা তখন ওকে আশ্বস্ত করে বলে,

"পাঁচদিনের ট্যুরে অন্তত একদিন একান্তে অনেকটা সময় তোমাকে আমি দেব। তবে কতটা কী পারব জানি না। আমারও তো বয়েস হচ্ছে।"

প্রেমিকার কাছে আশ্বাস পেয়ে আনন্দে ফোনের ওপারে সত্যেন হাত-পা ছুঁড়ছে, মানসচক্ষে তা দেখতে পেয়ে কৌতুকবোধ করছে মুকুলিকা।

দ্বিজেন আর সত্যেন দুজনের সঙ্গেই মুকুলিকার ফেসবুকে আলাপ। কিন্তু এখন তারা আর কোথায় ভার্চুয়াল ফ্রেণ্ড। দুজন রক্তমাংসের ভালো বন্ধু পেয়েছে মুকুলিকা। প্রেমিকদেরও ভালো বন্ধু হতে হয় বৈকি।

প্রথম সাক্ষাতের দিন মুকুলিকাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সত্যেন। এসেই অবশ্য সাত তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে হুড়মুড় করে অনেক গল্প করার ফাঁকে সে জানিয়েছিল, স্যান্ডি নয়, তার আসল নাম সত্যেন। বিচ্ছিরি নামটা সে ব্যবহার করতে চায় না, তাই...

শুনে মুকুলিকা ওকে জোর বকুনি দিয়েছিল,

"নামের আবার ছিরি বিচ্ছিরি কী? নিজের আইডেনটিটিকে কেন এভাবে অস্বীকার করবে? কক্ষনো না।"

আজ থেকে তুমি আমার সত্যেন।

তারপরই সাবলীল ভঙ্গিতে ওর হাত ধরতেই বেশ হকচকিয়ে গেছিল স্মার্ট সত্যেন।

দ্বিজেন কিন্তু প্রথম সাক্ষাতের দিন আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। বাস থেকে নেমেই মুকুলিকা কাছে এসে সাবানের সুগন্ধি ছড়িয়ে যেন কতদিনের চেনা এমন স্বরে বলেছিল,

"ইস, কাঁচাপাকা চুলে তোমাকে কী হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে।"

সেদিনই মুকুলিকার আবদারে জুঁইফুলের মালা কিনে খোঁপায় লাগাতে গিয়ে ওর ফর্সা ঈষৎ ঘেমে থাকা খোলা পিঠ দেখে কামনা উঁকি দিয়েছিল দ্বিজেনের মনে। মুহূর্তে নিজের গরম নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছিল দ্বিজেন যাতে মুকুলিকা কিছু না টের পায়। কিন্তু অন্যের মনের গোপন কথা জানতে পারে মুকুলিকা। পেছন ফিরেই হাসতে হাসতে সে বলেছিল,

"এই বয়েসে নিশ্বাস বন্ধ করে রেখো না। তোমার গরম নিশ্বাস আমার পিঠে পড়লেও কিচ্ছু মনে করব না আমি।"

মুকুলিকা মাঝপথে সত্যেনকে পিক-আপ করে শেয়ালদায় পৌঁছলো। দ্বিজেন যথারীতি আগেই এসে গেছে। তিনজনেই দার্জিলিং মেলের এসি কামরায় উঠল। জানলার ধারের সিটটায় বসল মুকুলিকা। ওর পাশে তাড়াতাড়ি সত্যেন। দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিজেনের কাঁধের ছোট্ট ব্যাগটা হঠাৎ লক্ষ্য করে মুকুলিকা অবাক হলো,

"এ কী! তুমি এই হ্যান্ডব্যাগটা নিয়েই যাবে নাকি?"

"এতেই হয়ে যাবে। ওখানে তো ঘাম হবে না। দু-একটা জামাকাপড়ই যথেষ্ট।"

"আমি জানতাম তুমি এই কাণ্ড করবে। তাই ভাগ্যিস তোমাকে গরম রাখার জন্যে একটা উইন্ডচিটার আর মাফলার নিয়ে নিয়েছি।"

একগাল হেসে দ্বিজেন মুকুলিকার তালুতে তালু ঠেকালো। তারপর ইশারায় সত্যেনকে ডেকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে এলো।

দ্বিজেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগনাল দেখছে। ট্রেন ছাড়তে মিনিটখানেক বাকি। ট্রেনের দরজার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে সত্যেনের হঠাৎ মনে পড়ল,

"এই যাঃ, জলই তো নেওয়া হয়নি।"

সে নামতে যাচ্ছিল, দ্বিজেন বাধা দিলো,

"তুমি নেমো না। আমি আনছি।"

দু' লিটারের দুটো জলের বোতল নিয়ে দ্বিজেন যখন এলো গড়াতে শুরু করেছে ট্রেন।

"সত্যেনদা, উঠে আসুন শিগগীর।"

জলের বোতলদুটো নিয়ে সত্যেন দ্বিজেনের ওঠার জায়গা করে দিল। দ্বিজেন না উঠে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে দ্রুত হাঁটছে আর হাসছে।

"কী হলো উঠবেন তো!"

দ্রুততর হাঁটতে হাঁটতে দ্বিজেন বলল,

"তোমরা দুজন যাও। আমার নাম করে মুকুল যে মাফলার নিয়ে এসেছে সেটা তুমি প'রো। হ্যাভ আ নাইস ট্রিপ...।"

ট্রেন এখন ভালো স্পীড নিয়ে নিয়েছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সত্যেনকে টাটা করছে দ্বিজেন।

ফিরে এসে সত্যেন সিটে বসতেই মুকুলিকা জিজ্ঞেস করল,

"দ্বিজেন কোথায়?"

"স্টেশনেই দাঁড়িয়ে থাকল দাদা। কিছুতেই উঠল না।"

কপাল কুঁচকে কয়েকমুহূর্ত সত্যেনের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে জানলার দিকে মুখ ফেরালো মুকুলিকা। সত্যেন নিচুগলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আরও কিছু বলার চেষ্টা করল। তবু জানলা থেকে মুখ সরালো না মুকুলিকা। এমন সময় টিকিটচেকার এসে টিকিট দেখতে চাইল। সত্যেন ওদের তিনজনের টিকিট চেকারসাহেবকে দিয়ে দ্বিজেনের জন্যে নির্ধারিত সিটটা দেখিয়ে অনুরোধ করল,

"স্যার, এই সিটটা কি এন.জে.পি. অবধি খালি রাখা যায় না?"

মুকুলিকা এবার তাকালো সত্যেনের দিকে। চোখ তার জলে টলটল।

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।