[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
পর্ব - ২৩
নজরুলের গান, হেমন্ত সরকারের সূচনা কথা এবং আহ্বায়ক হিসাবে শামসুদ্দিন আহমদের বক্তব্যে সভার সুর একপ্রকার বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। আজকের সভা মূলত বাংলার কৃষক-প্রজাদের নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগঠিত হবার দিন, আগামীতে সমবেত শক্তিতে লড়াইয়ের প্রস্তুত হবার দিন - টাউন হলে উপস্থিত ডেলিগেটদের মনে সেই বোধ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। নজরুল তাঁর গানের মধ্যে উপস্থিত কৃষক-প্রজার প্রতিনিধিদের মনে একটা জাগরণী সৃষ্টি করে দিতে সমর্থ হয়েছেন। এইরকম পরিবেশে সভার মূল পর্ব শুরু হলো - সভাপতির অভিভাষণ।
সভাপতি ডাঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত মাঠে ময়দানে বক্তৃতা দেবার মতো জননেতা নন। জ্ঞানী মানুষ এবং সুলেখকও বটে। নেতৃবৃন্দের সাথে একাধিকবার আলোচনা করে দীর্ঘ অভিভাষণ তিনি লিখে এনেছেন। বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনী, মূলত কৃষক সম্প্রদায়ের সামনে বর্তমান আয়োজকবৃন্দ অর্থাৎ নবগঠিত লেবার স্বরাজ দলের নেতৃবৃন্দ কোন বক্তব্য তুলে ধরতে চান, প্রজা সম্প্রদায়ের সামনে কোন দিশা দেখাতে চান - সেসবের পুরোটাই তিনি তার অভিভাষণে তুলে ধরবেন, এটাই ছিল প্রস্তুতি। সুতরাং তিনি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে অভিভাষণ মুসাবিদা করে এনেছেন। কিন্তু নিছক নিবন্ধ পাঠ হলে উপস্থিত সাধারণ জনতার মনোযোগ যে ধরে রাখা যাবে না - সে কথা তিনি বিলক্ষণ বোঝেন। সেই কারণে কিছুক্ষণ পাঠের পর নিজের ভাষায় মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছেন, প্রতিনিধিদের সামনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বিষয়বস্তুর উত্থাপন এতটাই স্পষ্ট এবং প্রজা-সম্প্রদায়ের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল যে হল ভর্তি মানুষ যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে দীর্ঘ অভিভাষণ শুনলেন, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন।
স্বাভাবিক ভদ্রতা ও সৌজন্যের ক্ষেত্রে নরেশ বাবু তার মতো ক্ষুদ্র সাধারণ ব্যক্তিত্বকে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সভার সভাপতির দায়িত্ব প্রদানের জন্য বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। ‘আমি কৃষক নই, প্রজাও নই, আপনাদের এই আন্দোলনের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগও নাই। তবুও আমি আপনাদের পর নই। কেননা আমি বাঙালি, আমি ভারতবাসী। দেশের মঙ্গল কামী।‘ প্রথমেই তাঁর এই সহজ সরল স্বীকারোক্তি উপস্থিত সকলের মন জয় করে নিল। শত শত বছর ধরে, বিশেষত ব্রিটিশ শাসনকালে অবহেলিত, প্রতারিত, দুর্দশাগ্রস্থ সাধারণ কৃষক-প্রজাসকল তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে আজকে যে সমবেত হয়েছে, তাকে তিনি বটবৃক্ষের বীজের সাথে তুলনা করে আগামীর স্বপ্নকে উদ্দীপিত করে দিলেন। ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট নীতি নির্ধারণ করে, আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু কৃষক-প্রজার মূল বিরোধ ঘটে ভূস্বামী জমিদার ও তাদের অধীনে বহু সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগী আর নায়েব-গোমস্তাদের সাথে। ফসলের ভাগ শুধু নয়, অধীনস্থ দাসের মতো ব্যবহার করে তারা সাধারণ প্রজাদের সাথে। কৃষকের মূল যে দাবির লড়াই - প্রজাস্বত্বের অধিকার, জমির উপর মালিকানার অধিকার, ন্যায্য খাজনার বিনিময়ে ভোগ দখল করার অধিকার, জমি বিক্রি করার অধিকার - এর প্রতিটি বিষয়েই সংঘাত বাধবে ভূস্বামী জমিদার আর তাদের অধীনস্থ মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বরাজের যে স্বপ্ন, বিদেশি শাসনমুক্ত স্বাধীনতা আন্দোলন কি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? দেশীয়রা নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে আর ব্রিটিশরা তো বসে বসে মজা দেখবে! তাহলে উপায় কী? প্রজা সম্মেলন তাহলে কোন পথ ধরে এগোবে?
সভার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, এক প্রকার অসন্তোষের হাওয়া বইতে শুরু করলো যখন সভাপতি লিখিত ভাষণে পাঠ করলেন - ‘স্বরাজ আমাদের চির আকাঙ্ক্ষিত। ভারতবাসী বলিয়া যে পরিচয় দেয়, ভারতের নামে যাহার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা আছে তার মনে স্বরাজ্য লাভের জন্য একটা তীব্র অদম্য আকাঙ্ক্ষা সতত জাগ্রত থাকিবেই... কিন্তু একটা কথা উঠিয়াছে যে, যখন আমরা বিদেশী গভর্নমেন্ট এর সঙ্গে স্বরাজ্য লাভের একটা বিরাট সংগ্রামে নিযুক্ত হইয়াছি তখন আমাদের যথাসাধ্য সমবেত হইয়া কার্য করা উচিত। আমাদের ভেতর যে বিরোধ আছে তাহাকে কোনমতে মাথা তুলিতে না দিয়া, এই বৃহৎ সংগ্রামে যথাসাধ্য একমত হইয়া চেষ্টা করা উচিত। অতএব বাঙ্গলার প্রজা দীর্ঘদিন ধরিয়া যে অবিচার সহিয়া আসিয়াছে ভূম্যধিকারীর সঙ্গে তাহার যে নিতান্ত সত্য বিরোধ আছে তাহাকে আপাতত ধামাচাপা দিতে হইবে’।
প্রত্যাশিত মতোই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এতো সেই একই পুরাতন কংগ্রেসি নেতাদের ভাষা। স্বদেশী আর স্বরাজ্য আন্দোলনের নেতা-মন্ত্রীরা তো প্রায় সবাই জমিদার, নবাব কিংবা বৃহৎ শিল্পপতি। তারা দেশকে বিদেশি শাসনের হাত থেকে মুক্ত করতে চায়, দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশ দাসত্বের শৃঙ্খলা মুক্ত করতে চায়। কিন্তু তাদের নিজেদের জমিদারি এলাকায় দেশমাতৃকার দরিদ্র কৃষক শ্রমিকদের শোষণ মুক্ত করার জন্য, তাঁদের অধীনে নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার আর বেগার খাটানো থেকে মুক্ত করার জন্য কোনো কথা নেই। এই কারণেই তো দেশবন্ধু কংগ্রেস ভেঙে স্বরাজ্য দল তৈরি করেছিলেন, সেই জন্যই তো প্রজাসম্মিলন, সেই জন্যই তো লেবার স্বরাজ দল গঠন - এসব কি তাহলে সেই কথার কথা? এমন স্বরাজ নিয়ে দরিদ্র কৃষক প্রজার লাভ কী? ‘লাঙ্গল যার, জমি তার’ এরকম স্লোগান গ্রামেগঞ্জে শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় ছোটলাট যে বিল আনতে চলেছেন - শোনা যাচ্ছে তাতে জমিতে কৃষক-প্রজার মালিকানা স্বত্ব এবং বিক্রয়ের অধিকার নিয়ে ভালো কিছু প্রস্তাবনা নাই । হেমন্ত সরকারের কথায় আর কাজী নজরুল ইসলামের গানে বহু আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে প্রজা সম্মেলনের সভা শুরু হয়েছে। কিন্তু সভাপতি এ কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন? ভূস্বামী জমিদারদের সাথে মারামারি করা, লাঠালাঠি করাটা কাম্য হবে না নিশ্চয়ই। তাই বলে বাংলার লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক, যারা মহাজনের কাছে কর্জ করে হাল-চাষ করে ফসল ফলায়, আর সেই ফসলের সিংহভাগ নিয়ে যায় যে জমিদারের পাইক-পেয়াদারা - সেই জমিদারের সঙ্গে ‘নিতান্ত সত্য বিরোধ আছে’ বলে স্বীকার করে নিয়েও তাকে আপাতত ধামাচাপা দিতে হবে? স্বদেশী আন্দোলনের জন্য এতকাল ধরে তো ধামাচাপা দেওয়াই ছিল!
শ্রোতার আসনে গুঞ্জন উঠলে তার হাওয়া মঞ্চে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে না। অভিজ্ঞ নরেশ সেনগুপ্ত অভিভাষণ লেখার সময়ই এটা আঁচ করেছিলেন যে এই অংশ শোনার পরে টাউন হলে একটা অসন্তোষের গুঞ্জন উঠতে পারে। উনি শান্ত স্বরে আবেদন জানালেন - আমি প্রস্তাবনার সামান্য অংশই উল্লেখ করেছি মাত্র। সভার পক্ষ থেকে এখনো অনেক কিছু বলবার বিষয় বাকি আছে। আপনারা এই পর্বের শেষে অবশ্যই নিজ নিজ মতামত পেশ করবেন। আপাতত বক্তব্যটি মন দিয়ে শোনার অনুরোধ জানাচ্ছি।
অচিরেই বোঝা গেল সভাপতি প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। কৃষক প্রজাদের দিকে তাক করে ছুঁড়ে দেওয়া তীরের অভিমুখ ধীরে ধীরে কৌশলী কায়দায় জমিদার নবাবদের দিকে সরে যেতে থাকলো। তিনি ধীরে ধীরে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে সংখ্যায় কৃষক-মজুরেরা বিপুল হলেও তাঁরা অসংগঠিত। ভূস্বামী জমিদার নবাবেরা একাধারে অর্থবান, অপরদিকে তাঁরা সংগঠিত। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিতেও তাঁদের প্রভাব বেশি। তাছাড়া সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে ব্রিটিশ সরকার যে ব্যবস্থা প্রণয়ন করে রেখেছে, সে ব্যবস্থার যেটুকুই প্রজার স্বার্থে পরিবর্তন করা হবে তাতে তাঁদের স্বার্থে আঘাত লাগবে। আর শুধু নবাব-জমিদার তো নয়, মাঝখানে আরও অনেক লোকজন আছে যারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবার আশংকায় বিরূপ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং খুব সহজে প্রজাস্বত্বের অধিকার স্থাপিত হবে বলে মনে হয়না। বাংলার কৃষক সমাজকে আরও সংহত হতে হবে, আরো বহু সংখ্যক মানুষকে একত্রিত হতে হবে। তার জন্য সময় এবং ধৈর্য্যের প্রয়োজন। যারা ভাবছেন আজকের সমাবেশের চেহারা তুলে ধরে লোকদেখানো একটা শক্তি প্রদর্শন করবেন এবং তার ফলে রাতারাতি স্বরাজের সুবিধা আদায় করে নিতে পারবেন তারা ভুল ভাবছেন। বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ব্যবস্থাপক সভায় দাবি তুলে ধরে যতটুকু পাওয়া যায় তাকে উপেক্ষা না করে গ্রহণ করতে হবে, পাশাপাশি বাকি ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
নিজেদের ভিতরে বিরোধ একেবারেই কাম্য নয়। যতটা পারা যায় বিরোধ এড়িয়ে যেতে হবে। জানি, আমাদের জাতির বর্তমান অবস্থা মোটেও শান্তির অনুকূল নয়। তবু স্বরাজের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যে যতদূর সম্ভব শান্তি বজায় রাখতে হবে। ‘কিন্তু এই শান্তির অজুহাতে সত্যের গলা টিপিয়া মারা আমি সমর্থন করিতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের দাবী অস্বীকার করাই যদি শান্তিলাভের একমাত্র উপায় হয় তবে সে শান্তি চাইতে আমরা পারি না। যাহাঁরা বলেন যে শান্তির খাতিরে আপাতত প্রজার এই সহজ অধিকারের দাবী অস্বীকার করা প্রয়োজন, তাঁহাদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন এই যে এমন অবজ্ঞা ও অন্যায় আবদারের উপর প্রতিষ্ঠিত যে শান্তি তাহার কোন মূল্যই নাই’।
টাউন হল জুড়ে তুমুল হর্ষধ্বনি। সভাপতির এই বক্তব্য শোনার পরে এতোক্ষণ যারা হতাশ ও বিরক্ত মুখে উদাসীন হয়ে উঠেছিলেন তারা আবার সোজা হয়ে বসলেন। নরেশবাবু অনুরোধের সুরে জানালেন - আপানারা মাঠে-ময়দানে কাজ করা প্রকৃত অর্থেই অভিজ্ঞ মানুষ। আমার চেয়ে ঢের ভালো আপনারা বুঝবেন কোন পন্থায় আমাদের অগ্রসর হওয়া উত্তম হবে। আমার কিছু নির্দিষ্ট ভাবনা আছে। অবশ্য আমি নিমিত্ত মাত্র। এই ভাবনা আয়োজক পক্ষে আমাদের সবারই। সেই ভাবনাগুলি আপনাদের সন্মুখে তুলে ধরতে চাই।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।