বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (দ্বিতীয় খণ্ড - দ্বিতীয় পর্ব) [ধারাবাহিক]



মমতা বিশ্বাস


মার্চ মাসের শুরুতেই শীত উধাও। এদিকে মাধ্যমিক- উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখার প্রচণ্ড চাপ। খাতা দেখতে গিয়ে মেজাজ ঠিক রাখা কুন্তীর সবসময় সম্ভব হয় না। পাশ করিয়ে দিতেই হবে প্রধান পরীক্ষকের নির্দেশ। উত্তর নেই ; শুধু প্রশ্ন টুকে রেখেছে। খুঁটিয়ে দেখতে হচ্ছে - শূন্যর পরিবর্তে ১/২ দেওয়া যায় কিনা। হস্তাক্ষর এতটায় খারাপ, কী লিখেছে উদ্ধার করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। পাশ করানোর দায়িত্ব নিতে কুন্তী নারাজ। এই নিয়ে ফার্স্ট লটের খাতা দিতে গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। রাত জাগতে হচ্ছে খাতা দেখার জন্য।


পলদা নদী

গভীর রাতে আলো নিভিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দেয় যখন, মায়ের হাতের শীতল স্পর্শের অভাব অনুভব করে। ২০২৪ এর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ বিনা নোটিশে মায়ের চলে যাওয়ায় দুই কামরার ফ্লাটে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। মহানগরের ইট-কাঠের জঙ্গল তাকে গিলতে আসে যেন। একের পর এক বাংলা মাধ্যম স্কুল উঠে যাচ্ছে। ওদের স্কুলের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। দেড় হাজার ছাত্রের স্কুলে যোগ দিয়েছিল ; এখন পাঁচশোতে এসে ঠেকেছে। ছাত্রসংখ্যা দ্রুত কমে আসাটাও মানসিক চাপের কারণ হয়ে উঠেছে। চাকরি তার যাবে না। কোনো না- কোনো স্কুলে পোষ্টিং পেয়ে যাবে। বেসরকারি স্কুলে, শহর মহানগর ছেয়ে গেছে। গ্রাম ও পিছিয়ে নেই। এই বেসরকারি করণের পিছনে আছে সরকারি মদত। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব নীতি নির্ধারণ হচ্ছে; তাতে সরকারের কৌশলী মনোভাবের পরিচয়; শিক্ষা সবার জন্য নয়। অন্যের দিকে আঙুল তুলতে গেলে নিজের দিকে একটা আঙ্গুল ঘোরানো থাকে। সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। শিক্ষককুলও তো নিষ্কলুষ নয়। বিশ্বায়নের আবর্তে ইমেজ ধরে রাখতে না পারায় সামাজিক সম্মান খুইয়েছে। বাস থেকে নামার পর প্রশ্নের তীর ছুটে আসে "মাস্টের/দিদিমণি কয়ডা বাজে" বলে, খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে, চায়ের দোকানে বা মোড়ের মাথায় বসে থাকা তাস পেটানো রাম, শ্যাম, যদু, মধু।

বইয়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে এইসব ভাবনায় পেয়ে বসেছিল কুন্তীর। তার উপর রবিবারের খবরের কাগজে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার বেহাল অবস্থা, শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতি, গ্রন্থাগারের দূরাবস্থা, জল সংকোট, পরিবেশ দূষণ, কেমন যেন এক তালগোল পাকানো অবস্থা। অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারিধার। সেই অন্ধকার ঢাকার জন্য মেলা, খেলা, উৎসব, মোচ্ছব, ভাণ্ডার, শ্রীর অনুদানের জোয়ার। মানুষকে বুঁদ করে রাখার ফন্দি।

বই সরিয়ে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে একটা বই টেনে বার করল।

রিনিপিসি আঠারো বছরের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল, 'সাতকাহন'।

ঝরঝরে মুক্তাক্ষরে লেখা,"খুকির জন্মদিনে - রিনিপিসি"।

হোলি-দোলের ছুটির সঙ্গে রবিবার জুড়ে যাওয়ায় তিনদিনের ছুটিতে রিনিপিসির কাছ থেকে ঘুরে আসবে বলে মন স্থির করে নিল কুন্তী। ভালো না লাগার রেশ আর টানতে পারছে না। ঠিক, সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় রিনিপিসির ফোন। এই পিসির সঙ্গে তার গভীর নাড়ির যোগ। মন খারাপের কথা তার রিনিপিসি কীভাবে যেন, জেনে যায়। যেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়; রিনিপিসির ফোন আসবেই। কত কথা হয়। এটায় কী তবে টেলিপ্যাথি?

প্রথম কথায় হল, "মন খারাপ বুঝি? গলার স্বরে বুঝে গেছি। মন থাকলে; তবেই খারাপ হয়। আমার কাছ থেকে ক'দিন ঘুরে যা; সব ঠিক হয়ে যাবে।"

রিনিপিসি নিজের সমস্যার কথা কোনো সময় প্রকাশ করে না। অন্যের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থাকে। পিসেমশাই মানুষটি সারাজীবন সমস্ত রকম দায়-দায়িত্ব রিনিপিসির উপর ছেড়ে দিয়ে সংসারে মুক্ত মানুষ থেকে গেলেন। দায়-দায়িত্বহীন মানুষটিকে খুব যত্নে রাখে। কিছুদিন হল পিসেমশাই-এর শরীরটা নিয়ে পিসি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। স্কুল, বাড়ি সামলাতে পিসিকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। পিসেমশায়-এর রিনিপিসির প্রতি উদাসিনতায় কুন্তীর খুব রাগ হয়। প্রকাশ ও করে ফেলে।

তখন রিনিপিসি বলে, "মেয়েদের, সংসার টিকিয়ে রাখতে গেলে কত কিছু সহ্য করতে হয়? তুই তার কী বুঝবি!সংসার তো আর করলি না।"

কুন্তী, কেমন আছে জানতে চাইলে; রিনিপিসি হা হা করে হেঁসে উত্তর দেয়, "আমার শরীর তো ভালোয় আছে। কিন্তু তোর পিসেমশায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে যাব ভাবছি।"

এবারও কী গাড়ি ভাড়া করে আসবে? ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে যাবে?

"হ্যাঁ, তাই করতে হবে। এমন অসুস্থ মানুষ নিয়ে তোর ওখানে ওঠা ঠিক হবে না। দোলে তো তিন দিন ছুটি। আয়, ঘুরে যা।"

"এতটা রাস্তা গাড়িতে আসা-যাওয়ায় তোমাদের খুব কষ্ট হবে। তুমি বরং ট্রেনে করে চলে এসো আমার এখানে। হোলির আগের দিন চলে যাব তোমার ওখানে।"

"ছ'মাস চাকরি আছে। স্কুলে আর কোনো শিক্ষক/শিক্ষিকা নেই। আমি না গেলে স্কুলের ঝাপটা খুলবে কে? অবসরের পর তখন গিয়ে থাকব। বনবিবিতলায় যাবি বলেছিলি। এবার আসলে নিয়ে যাব।"

"তোমাদের স্কুলের আরো তিন জন দিদিমণি, একজন মাস্টার মশাই ছিলেন না?"

প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে অন্য স্কুলে বদলি হয়ে গেছেন। শিক্ষাব্যবস্থায় একটা অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে। সুষ্ঠ নিয়োগ নেই। কোথাও শিক্ষক/শিক্ষিকা আছে তো - ছাত্র-ছাত্রী নেই; আবার কোথাও ছাত্র-ছাত্রী আছে তো শিক্ষক/ শিক্ষিকা নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে কী যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলার নয়!"

"গত রবিবারের কাগজটা পড়েছো? ভালো কোনো খবর নেই। মন-মেজাজ ভালো থাকে? হোলির ছুটিতে যাচ্ছি তাহলে। সেই পলদার ধারের বনবিবিতলার কথা বলছো তো? অবশ্যই যাব। ভালোয় হবে পলদার বিলটা দেখা হয়ে যাবে।"

"বিল-খালের কথা শুনলে পাগল হয়ে যাস, এক্কেবারে !খাল-বিলে কী আর জল আছে রে? বর্ষার সময় হাঁটু জল, কোনোবার কোমর সমান জল হয়। বাঁকী সময়টাতে চাষ-আবাদ হয়। পলদার বিল হয়ে ওঠে কিশোর-যুবকদের ফুটবল, ক্রিকেট খেলার মাঠ। গরমে হাওয়া খাওয়ার জায়গা। গরু, মোষ, ছাগল- ভেড়ার চারণভূমি। পলদার বিলের সঙ্গে দামোদরের বিলের যোগ আছে, এদিকে আবার কলিঙ্গের সঙ্গে। এই জোড়ার কাজটা খাল করেছে। বনবিবিতলায় ঘুরতে আসে কত্ত মানুষ। ভালো পিকনিক স্পট। বটগাছ ঝুরি নামিয়ে আড়ে দীঘিতে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। মূল গাছ কোনটি বোঝার উপায় নেই। বট পাতার ফাঁক গলে সূর্যোলোক প্রবেশ করতে পারে ন। পৌষমাসে বাউলমেলা হয়। তোর বান্ধবী নূপুরের বাবার বাড়ি ময়দানপুরে। ককলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ত তোর সঙ্গে।। মনে পড়ছে? স্কুলে যাওয়ার পথে টোটোতে পরিচয় হল। দোয়ের বাজারে থাকে। আমার এখানে আসলে তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।"

"মনে পড়বে না কেন ? ভালো মেয়ে। পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিল। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। যোগাযোগ নেই কতদিন। শুনেছিলাম কলেজে পড়ায়। তোমার ওখানে গিয়ে, অবশ্যই যাব।"

"এখন রাখি খুকি। ভালো থাকিস। খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে করিস।"

"এত বয়স হয়ে গেল; তবুও তোমার খুকি থেকে গেলাম। তুমিও ভালো থেকো।"

রিনিপিসির সঙ্গে কথা বলে মনের গুমোট ভাবটা কেটে গেল। সাতকাহনটা আবার হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে থাকে। থেমে গেল একটা পাতায় এসে। কয়েকটি লাইন পেন্সিল দিয়ে আণ্ডার লাইন করেছিল পড়ার সময়।

পিসির কড়া নির্দেশ ছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে, তবে বইটি পড়বে। কুন্তী, পিসির এই কথাটি রাখতে পারেনি। পরীক্ষার পড়ার ভান করে সাতকাহন পড়তে শুরু করে। মনুষ্য চরিত্রের কত অজানা দিক; দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার সামনে। সাতকাহনের আলোর লড়াই, তার অন্ধকার কুঠুরিতে আলো জ্বেলে দিয়েছে।

'একফোঁটা চোখের জল, দশ ফোঁটা রক্তের সমান।' বিপদের সময় কান্না মানে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করা, বরং চোয়াল শক্ত করে মোকাবিলা করতে হবে। আর চোখের জল কখনোই প্রকাশ্যে নয়; ফেলতে হবে আড়ালে!"

সাতকাহন শেষ হবার পর পিসিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, "এ আমাকে কী বই উপহার দিলে পিসি! আলোর আলোয় আমি আলোকিত হয়ে উঠেছি।

এখন মনে হচ্ছে সেই আলো স্তিমিত হয়ে আসছে। না, না, এমন হতে দেওয়া যাবে না। সাতকাহনটা আবার পড়তে হবে।

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।